ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

কে এই আবি আহমেদ আলী?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/10/2019


Thumbnail

শান্তিতে এবছর নোবেল জিতেছেন আবি আহমেদ আলী। তিনি ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব আফ্রিকার এমন একটি দেশ থেকে নোবেল জিতে নেওয়ার কারণগুলোই এখন জানাবো আপনাদের।

দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত-সংঘর্ষ, বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর নিজেদের মধ্যে বিবাদে দেশটি প্রায় গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল ইথিওপিয়া। আবি ক্ষমতায় এলেন, আর জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বদলে দিলেন সবকিছু।

মাত্র গত বছরেই ক্ষমতায় এসেছেন আবি। এরই মধ্যে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন অনেকটাই।

২০১৮’র বছরের জুলাইয়ে আবি ইথিওপীয় অধ্যুষিত যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গরাজ্য সফরে যান। সবার শেষে তিনি যান মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে। সেই অঙ্গরাজ্যের টার্গেট অ্যারেনা স্টেডিয়ামে জনসভার আয়োজন করা হয়। ভোর ৬টার মধ্যেই পুরো স্টেডিয়াম ভরপুর। প্রায় ২০ হাজার ইথিওপীয় তাদের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে সামনাসামনি দেখতে ও তার কথা শুনতে জড়ো হন।

তাকে দেখে চারপাশে সবাই আনন্দে কাঁদছিল। মনে হচ্ছিল সবার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। মানুষ কাঁদছিল কারণ এই প্রথম তারা আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। মানুষ অবশেষে তাদের মনের মতো একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, সে খুশিতে কাঁদছিল।

কেন এত জনপ্রিয়তা?

২০১৮’র ২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর আফ্রিকা মহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ এ সরকারপ্রধান খুব দ্রুত এমনকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো দেশে-বিদেশে ইথিওপীয়দের মনে আশার সঞ্চার করেছে। ক্ষমতায় এসেই তিনি হাজারো রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিয়েছেন, সেন্সরশিপের নামে বন্ধ থাকা শত শত ওয়েবসাইট চালু করেছেন, ইরিত্রিয়ার সঙ্গে ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের ইতি টেনেছেন, রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থা তুলে নিয়েছেন, দেশের অর্থনীতি ও ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করেন।

রাজধানী আদ্দিস আবাবার চিত্রটাই পাল্টে যায়। আগের সরকারের চাপে পিষ্ট মানুষগুলো এখন বুক উঁচিয়ে হাঁটতে পারছে। কয়েক দশক ধরে যেটি তাদের জীবনে ছিল না।

আদ্দিস আবাবার রাস্তাঘাট থেকে গাড়ির সামনে-পেছনের গ্লাসে প্রধানমন্ত্রীর ছবির স্টিকার সেঁটে রেখেছিল সবাই, তার ছবি সংবলিত টি-শার্টের জন্য তাদের জনগণ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।

লোকজন তাদের ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও তার বিভিন্ন বার্তা দিয়ে প্রোফাইল ছবি দিতো। গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী আহমেদ রাজধানীর মেসকেল স্কয়ারে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

ইথিওপিয়ায় ৯০টিরও বেশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত। দশকের পর দশক দেশটির রাজনীতি যে ঘূর্ণাবর্তে ছিল, তাতে এ বিভেদ আরও বেড়েছে। সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাম ‘ওরোমো’। দেশের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষই এ সম্প্রদায়ের। প্রধানমন্ত্রী আবিও এ সম্প্রদায়ের। ইথিওপিয়ার অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, ওরোমো থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী না হলে গৃহযুদ্ধ নিশ্চিত।

১৯৯১ সালে দ্য টাইগারিয়ান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) একনায়ক মেঙ্গিস্টু হাইলে মারিয়ামের বিরুদ্ধে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যিনি ১৯৭৪ সাল থেকে ইথিওপিয়ায় সেনা শাসন জারি রেখেছেন এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন রাজনৈতিক বিবেচনায় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন। তার সময়ে দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে।

টাইগারি নৃ-গোষ্ঠী থেকে কিছু গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে টিপিএলএফ প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। টিপিএলএফের ক্ষমতা যখন বাড়ছিল, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল দেশের বড় বড় নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে তাদের দলে টানতে হবে, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে।

১৯৮৯ সালে টিপিএলএফ ওরোমো এবং আমরাহার মতো সবচেয়ে বড় দুটি নৃ-গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট করতে সক্ষম হয়। জোটের নাম দেওয়া হয় ইথিওপিয়ান পিপলস রেভ্যুলুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইপিআরডিএফ)। দেশের অস্থিরতা দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হাইলে মারিয়াম পদত্যাগ করেন, যেটি আফ্রিকা মহাদেশে খুবই বিরল ঘটনা। ১৮ মাসের মধ্যে দেশে দ্বিতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং দেশজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহার কমিয়ে ফেলা হয়।

আবি আফ্রিকা অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রনায়কের মতো নন। জনগণের সঙ্গে তার দূরত্ব কম, জনবহুল স্থানে গিয়ে তিনি মানুষ ও অন্যান্য রাজনীতিকদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন, সেলফি তোলেন, জনসভা মাতিয়ে রাখেন। ইথিওপিয়ার নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে তিনি নিজেদের মধ্যে ‘দেয়াল তৈরি না করে সেতু তৈরি করতে’ বলেন।

মিনেসোটার জনসভায় আবি বলেন, ‘আপনারা যদি এই প্রজন্মের গর্ব হতে চান, তাহলে ওরোমো, আমহারা, ওলেয়টাস, সিলটেসসহ সব নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। সবাইকে সমান ইথিওপীয় হিসেবে গণ্য করতে হবে।’

এটা একটা বৈপ্লবিক বার্তা। ইথিওপিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যে গোষ্ঠীগত বিভেদ, সর্বমহলে জনপ্রিয় একজন প্রধানমন্ত্রীর এমন বার্তায় সেটি কমে আসবে।

প্রধানমন্ত্রী আবি বিস্ময়করভাবে সব নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সমান জনপ্রিয়। তার নিজের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী। তার বাবা ছিলেন ওরোমো মুসলমান এবং মা ছিলেন খ্রিস্টান। তিনি ওরোমো, আমরাহা, টাইগারি ও ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী। মিনেসোটার ওই জনসভার ভাষণে তিনি ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় তিনটি ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ সোমালিয়ার মানুষদের সম্মানে তিনি সোমালি ভাষায়ও কথা বলেছিলেন।

বহু নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় পারদর্শী হওয়ার ফলে জনগণ প্রধানমন্ত্রীকে তাদের নিজেদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাবতে পারেন। আবার তার বর্ণময় জীবনও এ জনপ্রিয়তার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

১৯৯০-এর দশকে আবি রুয়ান্ডায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ইথিওপিয়ার সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি আইএনএসএর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন এবং দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ওরোমিয়া অঞ্চলের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

ইতোমধ্যে মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জিবুতি ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে সক্রিয় রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন আবি।

ক্ষমতায় এসেই আগের সরকারগুলোর সময়ে রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর চালানো নির্যাতনের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন আবি।

অনেক আলোচনা-সমালোচনার মাঝেও ইথিওপিয়বাসী মনে করে আবি’র মতো মানুষ লাখে একজন পাওয়া যায়। আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা নেতা হওয়ার সম্ভাবনা তার মধ্যে আছে। এখন বিশ্বও জানবে আবিকে।

 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭