ইনসাইড থট

সংখ্যা দুর্নীতির স্যুট টাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/10/2019


Thumbnail

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটা সাংঘাতিক ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলেছেন। তিনি যা বলেছেন সেটা এমন যে, একা কোন রাজনীতিবিদ বা ঠিকাদার টেন্ডার বা কেনাকাটায় দুর্নীতি করতে পারে না, সাথে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গোয়েন্দাদের যোগসাজশ যদি না থাকে। এটা সম্ভব নয়। এটা নিয়ে সিনিয়র সাংবাদিকগণের অনেকেই লিখেছে আবার ইউটিউব চ্যানেলে তাঁর পর্যবেক্ষণেও সেই কথার একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। আমি এই দুজনের বা অনেকের কথা স্বপক্ষে কিছু তথ্য গল্পের ঢঙ্গয়ে তুলে ধরতে চাই।

সেটা ১৯৮৮ সালের দিকের কথা। তখন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে শুল্ক মুক্ত গাড়ি আর প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আনার নিয়ম ছিল। প্রকল্প শেষে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারী দপ্তর বা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ট্যাক্স দিয়ে দিতেন যা আগে থেকে ডিপিপি তে উল্লেখ করা থাকতো। লম্বা সময়ের প্রকল্প হলে অনেক সময় ঝামেলাও হতো আমদানি শুল্ক দেওয়া নিয়ে। তখন চরম আকারে সংখ্যা দুর্নীতির প্রচলন ছিল। কেন না সে সময় ঋণ প্রকল্পের সংখ্যা ছিল খুব কম, কিন্তু টেকনিক্যাল কো-অপারেশন প্রকল্পের সংখ্যা ছিল বেশি। এসব প্রকল্পের উপাদান ছিল ৩ টি। এক- বিদেশী বিশেষজ্ঞ, দুই- যন্ত্রপাতি, তিন- প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণ।

মূল দুর্নীতি হতো প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার কৌশল। ধরণ ভেদে বিভিন্ন প্রকল্পে ৩ বা ৫টা শুল্ক মুক্ত গাড়ি, কিছু এসি, একটা বা দুইটা রেফ্রিজারেটর, কালার টিভি আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি আমদানি করা হতো। আমদানির জন্য আসা ইনভয়েস আর বিল ও লেডিং এ হতো টেম্পারিং। ১ কে কোন সময় ১০ আর ৩ কে ১৩ বা ৫ কে ১৫ বানিয়ে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে গাড়ি, এসি, রেফ্রিজারেটর, কালার টিভির সাথে অন্যান্য যন্ত্রপাতি খালাস করা হতো পোর্ট থেকে। খালাস হয়ে গেলে অরিজিনাল ইনভয়েস আর বিল ও লেডিংএ সীল সাক্ষর মেরে কাস্টমস হাউজের মূল ফাইলে রেখে দেওয়া হতো যাতে পরে তদন্তে ধরা না পড়ে। এসি, রেফ্রিজারেটর, কালার টিভির সাথে অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে কোন ঝামেলা হতো না, ডিপিপিতে উল্লেখিত সংখ্যা অনুযায়ী প্রকল্প শেষে আমদানি শুল্ক পরিশোধ করে দেওয়া হতো। খেলা জমতো শুল্কমুক্ত আমদানি করা গাড়ি নিয়ে। কারণ তখন প্রায় সব প্রকল্পেই মিটসুবিশি পাজেরো আনার ঝিক ছিল খুব বেশি। পাজেরো তখন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।

এবার আসি আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা গাড়ি রেজিস্ট্রেশন প্রসঙ্গে। রেজিস্ট্রেশনের যে সব কাগজ জোগাড় করা দরকার তা করা হতো বিআরটিএ মিরপুর অফিসের অসাধু কর্মীদের সহায়তায়। জাল কাগজ তৈরি করে মাত্র ৪০ হাজার টাকায় কোন কোন সময় ৬০ হাজার টাকায় রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হতো। রেজিস্ট্রেশন দেওয়া রেজিস্টারে প্রতিটি মডেলের গাড়ির জন্য ১৫/২০ টা ঘর ফাঁকা রাখা হতো বছর শেষেও, যাতে ঐ মডেলের গাড়ি এলে রেজিস্ট্রেশনের সেই সিরিয়ালে নাম্বার দেওয়া যায়। রেজিস্ট্রেশন দেবার পরে বছর না ঘুরতেই বিআরটিএ মিরপুর অফিসের স্টোর রুমে সর্ট সার্কিটে আগুণ লাগতো বা উইপকার আক্রমন হতো। পুড়ে যেতো, নষ্ট হতো অনেক প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট। রেজিস্ট্রেশন দেওয়া রেজিস্টারে ধরে ইস্যু করা হতো ডুপ্লিকেট ব্লু বুক বা রেজিস্ট্রেশন বই। কাস্টমস ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে এটা জানাজানি হয়ে যায় এরশাদ সরকারের আমলের শেষ দিকে। এরশাদ সরকারের আমলে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রকল্পের শুল্কমুক্ত আমদানি। ইতোমধ্যে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কয়েক শ’ লোক রাতারাতি কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে যান। গাড়ির এই ভুয়া রেজিস্ট্রেশন এখনো চালু আছে কিন্তু অন্য ফর্মে। সেটা পরে বলা যাবে। পাঠকদের বলি আপনারা দয়া করে একটু এনবিআরএর আইন ঘেঁটে দেখুন কবে থেকে বিভিন্ন সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পে (ঠিকাদারি সুবিধা বাদে) শুল্ক মুক্ত আমদানি বন্ধ হয়েছে। আর ২০০৭ -৮ আত্ম স্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের তালিকায় বিআরটিএ’র কত জনের নাম আছে। দলিল দিয়ে প্রমাণ করা লাগবে না।

সাম্প্রতিক কালের বালিশ পর্দা, বই কেনায় দুর্নীতিতেও আছে এই সংখ্যা তত্ত্বের কারসাজি। ২৭০০ টাকার বালিশের দামের ডান দিকে একটা শূন্য বসিয়ে দিলেই তা ২৭,০০০ হয়ে যায়। এভাবেই ৬০০ টাকার বালিশ তোলার লেবার খরচ ৬০০০ হয়ে যায়। কিংবা ৮০০ টাকার বালিশের কভারের ডান দিকে একটা শূন্য আর বাম দিকে ২ বসালে বালিশের কভারের দাম ২৮,০০০ হতে সময় লাগে না। বিভিন্ন প্রকল্পের বড়রা স্যুটটা নিলে নীচের ছোটরা টাইটা নিয়ে যান এভাবে- মিটিং এ দেওয়া নাস্তার ৩০ টাকার সন্দেশের দামের মানি রিসিটে ডান দিকে একটা শূন্য বসালেই ৩০০ হয়ে যায়, ৩৫০ টাকার লাঞ্চ হয়ে যায় ৩,৫০০ টাকা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এর আগের একটা লেখায় বলেছিলাম যে, বিভিন্ন ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির চিত্র ভিন্ন। আমরা একটা অবকাঠামো তৈরির প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির খণ্ড চিত্র বা কিছু ইঙ্গিত দিতে পারি। মনে করি কোন এলাকায় ২টা ব্রিজ হবে সাথে ব্রিজের এপ্রোচ রোডের জন্য কিছু নতুন রাস্তা হবে, তাই জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এই কথা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দপ্তরের মাধ্যমে চলে যার সংশ্লিষ্ট ডিসি অফিসে, এসি ল্যাণ্ড অফিসে। প্রকল্প অনুমোদনের নিশ্চয়তা পেলে এসি ল্যাণ্ড (যদি অসৎ হন) আর তার দালালেরা রাতারাতি সম্ভাব্য অধিগ্রহণ এলাকায় টিন সেড বাড়ি তরী করে, কাঁচা বাড়ি তৈরি করে সয়লাব করে ফেলে। পরে আবার ৩০ টা বাড়ি একটা শূন্য বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়। কারণ ক্ষতিপূরণ ৩০০%। কিন্তু সেই টাকার প্রায় সিংহভাগ চলে যায় এসি ল্যাণ্ড আর তার বস ও দালালের কাছে।

আবার, মনে করুন রাস্তা বা ব্রিজের ডিজাইন করার জন্য মাটি পরীক্ষা করা দরকার। মনে করুন ১০ পয়েন্টে সয়েল টেস্ট করতে হবে। সেখানে ১ টা শূন্য বাড়ালেই হবে ১০০ টি। যে কোম্পানি কাজ পেলো তাকে বেছে বেছে ১০ টি বোরিং করে সয়েল টেস্ট রিপোর্ট দিতে বাধ্য করা হয় বাকীগুলোর জন্য। সরকারী ভবন তৈরির ক্ষেত্রেও একই ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে রপড এর মত দামী উপাদানে নিম্ন মানের উপাদান ব্যবহার করা। যদিও ফাইলে এইচবিআরআই বা বুয়েটের প্রকল্প বাস্তবায়নে যার প্রভাব পড়ে, তখন একই ধরণের বেসরকারী বা বিদেশী স্থাপনার খরচ আরও বেড়ে যায়। টাকা চলে যায় বিদেশে।

এভাবেই শুধু সংখ্যার হেরফের করে চলে সীমাহীন দুর্নীতি যাকে অনেকে ঠাট্টা করে বলে ‘সংখ্যা দুর্নীতির স্যুট টাই খেলা’।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭