ইনসাইড আর্টিকেল

স্মরণে ফকির লালন শাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/10/2019


Thumbnail

`মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি`-

কথাটি বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের। তিনি মানুষের ভেতরের মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবনভর যুদ্ধ করে গিয়েছেন। ১৭৭৪ সালে তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মান তিনি। তৎকালীন ভারতবর্ষে নদীয়া জেলার অন্তর্গত মহকুমা ছিল। কুমারখালী ছিল তখন ইউনিয়ন। লালন গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাড়ারা গ্রামের হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন শ্রী মাধব কর আর মা ছিলেন শ্রীমতি পদ্মাবতী।

আমরা বরাবরই ভুলে যাই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা মানুষ। আমাদের এই ভুলে যাওয়ার ফলাফল আজ আমরা বিশ্বব্যাপী দেখতে পাচ্ছি।  দেশে দেশে যুদ্ধ, নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর অত্যাচার সবই হচ্ছে ধর্মের নামে। কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আজ থেকে ২৪৩ বছর আগে লালনও মুখোমুখী হয়েছিলেন অসুস্থ সমাজ আর ধর্মব্যবসায়ীদের।

লালন শৈশবেই তার বাবাকে হারান। মায়ের আদর স্নেহে বেড়ে উঠেন তিনি। পরিবারের প্রধান বেঁচে না থাকায় লালন সংসারের হাল ধরেন। মায়ের দেখাশুনা করার জন্য লালন বিয়ে করেন। লালন খুব নীতিবান ছিলেন। তার প্রমান হলো আত্মীয় স্বজনদের সাথে তাঁর বনিবনা না হওয়ায় মা ও স্ত্রীকে নিয়ে একই গ্রামের দাসপাড়ায় নতুন করে বসতি গড়েন। তিনি শৈশব থেকেই  সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, ফলে পড়াশোনা করতে পারেননি। তবে গানের প্রতি তার অন্যরকম টান ছিলো। ভাড়ারা গ্রামে কবিগান,পালাগান,কীর্তন সহ নানা রকম গানের আসর বসতো। তিনি সেই আসর মাতানোর একজন ছিলেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতো।

লালন পূণ্যলাভের আশায় যৌবনের শুরুতে ভাড়ারা গ্রামের দাসপাড়ার প্রতিবেশী বাউলদাস সহ অন্যান্য সঙ্গী-সাথী নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে। গঙ্গাস্নান সেরে লালন যখন সঙ্গীদের নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তিনি আকস্মিকভাবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সঙ্গীরা মনে করলেন তিনি মারা গেছেন।  তারা তার মুখাগ্নি করেই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সঙ্গীরা তার মা এবং বউকে তার মৃত্যুর খবর দেন। অদৃষ্টের করুণ পরিহাস মনে করে তার মা এবং বউ তার মৃত্যু মেনে নেন এবং ধর্মমতে সমাজকে নিয়েই তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

পুত্রের ফিরে আসায় মা আনন্দে আত্মহারা আর স্বামীর ফিরে আসায় স্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানায় সৃষ্টিকর্তাকে। মৃত মানুষ ফিরে এসেছে এই খবর শুনে আশেপাশের মানুষজন লালনকে দেখতে আসে। সমাজপতিরাও আসেন লালনকে দেখতে। তবে যতটা না দেখতে তার থেকে বেশি তাদের নিয়মনীতি দেখতে। সেদিন ধর্মের অজুহাতে লালনকে সমাজ থেকে বের করে দেয়া হয়। বিচ্যুত করা হয় মা ও স্ত্রীর কাছ থেকেও। লালনের স্ত্রী লালনের সঙ্গে গৃহত্যাগী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু সমাজের শাসনে তার সে পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। এই যন্ত্রণায় লালনের স্ত্রী কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন ।

এরপর সময় গড়ায় অনেক। সাধারণ মানুষ সে হোক হিন্দু কিংবা মুসলিম সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। কারণ লালনের গানের মধ্যে তারা মানবমুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়। জাত-পাতহীন ধর্ম-বর্ণহীন সমাজের কথাই ছিল লালনের গানের মূল কথা।

ধর্মের অজুহাতে সমাজপতিরা তাঁকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করে এই মর্মবেদনা লালনকে দারুনভাবে পীড়া দেয়। মূলত এখান থেকেই তার ভাবনার বিকাশ ঘটে।

লালন মনে করেছেন ধর্ম হলো তাই যা ধারণ করা হয়। বাউল মন যা ধারণ করে সেটাই বাউলের ধর্ম। মানব আত্মার মুক্তির জন্য তাদের জীবনভর যে সংগ্রাম তা কখনই সহজ ছিল না। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মেরই যারা সমাজকে শাসন করেছে, সমাজের মানুষকে ধর্মেও চাবুকে নিজেদের আঘাত করেছে তারা সবাই লালনকে নাড়ার ফকির, অশিক্ষিত, মুখ্য বলে অপবাদ দিয়েছে। সেই সাথে অপপ্রচার করেছে তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। খেটে খাওয়া পিছিয়ে পড়া মানুষেরা লালনের গান শুনে তাঁদের জীবনের সন্ধান পেয়েছে। খুঁজে পেয়েছে আত্মার শান্তি। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম কি নেই লালনের গানে।

সাধক লালন শোষিতের পক্ষে এবং শোষক শ্রেনীর বিরুদ্ধে ছিলেন। যে হাতে তিনি একতারা নিয়ে মানবতার গান গেয়ে চলেছেন প্রয়োজনে সেই হাতে লাঠি তুলতে কুন্ঠাবোধ করেননি। কারন সৎ পথে, সৎকাজে তিনি ছিলেন অবিচল । যা তাঁর গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন-

সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন।

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে বাউল সম্রাট মরমী সাধক লালন শাহ্‌ ইন্তেকাল ত্যাগ করেন। যেদিন ভোরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ঐ দিনও সারারাত ধরে আখড়ায় বাউল গান নিয়ে শিষ্য ভক্তদের সময় দিয়েছেন। ভোর ৫টায় তিনি সকল ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমি চলিলাম”। এই কথার আধাঘন্টা পর তিনি সকলকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যিই একেবারে চলে যান।

লালনের উৎস সন্ধানে এখনও মন গেয়ে ওঠে-

লালন তোমার আরশীনগর

আর কতদূর…আর কতদূর…

 

 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭