ইনসাইড বাংলাদেশ

সুলতান রাজীব: নিচ থেকে উপরে, উপর থেকে মাটিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 21/10/2019


Thumbnail

কী ছিলেন, আর কী হলেন! হিসাব মেলানো যায় না। এ এক অবিশ্বাস্য উত্থানের কাহিনী। কাউন্সিলর পদ যেন আলাদীনের চেরাগের চেয়েও বেশি কিছু। ফুঁ দিলেই বদলে যায় সব। বদলে গেছে যেমন তারেকুজ্জামান রাজীবের জীবনও। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। স্থানীয়রা বলেন, কাউন্সিলর হওয়ার পরপরই সম্পূর্ণ বদলে যান রাজীব। তার চালচলনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

হঠাৎ কেউ দেখলে মনে হবে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাজা, বাদশাহ বা সুলতান। কোথাও গেলে সঙ্গে থাকে গাড়ি আর মোটরবাইকের বহর। রাস্তা বন্ধ করে চলে এসব গাড়ি। রোদে গেলে আশেপাশের কেউ ধরে রাখে ছাতা। সঙ্গে ক্যাডার বাহিনী তো আছেই। মাত্র চার বছরে মালিক বনে গেছেন অঢেল সম্পত্তি, গাড়ি আর বাড়ির। ইচ্ছে হলেই বদলান গাড়ি। রয়েছে মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্স। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দিয়েছেন বাড়ি-গাড়ি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের খোঁজ করতে গেলে ঠিক এভাবেই বর্ণনা করেন এলাকাবাসীরা। সম্প্রতি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই খুব বেশি দেখা যায়নি রাজীবকে। গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা জানান। তবে আত্নগোপন করেও শেষ রক্ষে হয়নি সুলতানের। শনিবার রাত ১১ টায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে রাজীবকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানায় র‍্যাব।

তারপরেও অনুসন্ধান চালাতে চান মিয়া হাউজিং এর ৩ নম্বর গলি বরাবর তার অফিসে যাওয়া হয়। একটি আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং এর দুতলায় তার অফিস। পুরোনো টিন দিয়ে ঘেরাও করা রয়েছে। মুল ফটকের সামনে আরামছে বসে রয়েছে বাচ্চা সহ ৬ টি কুকুর। দেখেই যেন মনে হচ্ছে সুলতানকে হারিয়ে তাঁর রাজ্যময় কেবল বেদনার সুর। সরাসরি উঠে গেলাম দুতলায়, রাজীবের কক্ষটিতে তালা ঝুলছে, তার পার্সোনার সেক্রেটারি সাইদুর রহমান জানালেন কাউন্সিলর অফিসে নেই।

তারেকুজ্জামান রাজীবের গ্রেফতার হওয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

তবে গ্রেফতারের আগে গায়েব থাকা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে সাইদুর রহমান বলেন, ‘রাজনীতিবীদরা অবস্থা অনুযায়ী কৌশলতা অবলম্বন করেন, কাউন্সিলর সাহেবও তাই করেছেন। তিনি গায়েব এ তথ্য সঠিক নয়, মাঝেমধ্যে অফিসে আসতেন তিনি’।

মাঝেমধ্যে আসলে দাপ্তরিক কাজগুলো কিভাবে করেন এমন প্রশ্নের জবাবে সাইদুর রহমান জানান, ‘আমাদের বেসিক কাজ ওয়ার্ডের জনগণদের সহযোগিতা করা। এই ধরুন, আমরা নাগরিক সনদ পত্র দিয়ে থাকি। কাউন্সিলর সাহেবের সাইন করা খালি সনদপত্র রেখে দেয়। প্রয়োজনে সেটা ব্যবহার করি।

প্রশ্ন হচ্ছে, একজন নাগরিকের নাগরিক সনদপত্র কিংবা চারিত্রিক সনদপত্র প্রধান করেন একজন কাউন্সিলর। সেখানে খালি কাগজে পুর্বে থেকে সাইন করে রাখাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত। এ বিষয়ে সাইদুর রহমান কোনো মন্তব্য করেনি।

শেখ হাসিনার শুদ্ধি অভিযান নিয়ে সাইদুর রহমান বলেন, মাননীয় মন্ত্রীর এই অভিযানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্মতি জানাই। অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়াটায় একজন আদর্শ নেত্রীর গুণাবলি।

সুলতান রাজীবের ইতিবৃত্ত

প্রায় ছয় বছর আগে মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির একটি বাড়ির নিচতলার গ্যারেজের পাশেই ছোট্ট এক কক্ষে সস্ত্রীক ভাড়া থাকতেন তারেকুজ্জামান রাজীব। ভাড়া দিতেন ছয় হাজার টাকা। তখনো তিনি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন না। এখনো করেন না। কিন্তু পরিবার নিয়ে থাকেন একই হাউজিং এলাকায় নিজের ডুপ্লেক্স বাড়িতে। আগে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে রাজীব চলাফেরা করতেন। এখন কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন। নতুন নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনার নেশা রয়েছে তাঁর। যেখানেই যান, তাঁর গাড়িবহরের সামনে-পেছনে থাকে শতাধিক সহযোগীর একটি দল। এসব কারণে মোহাম্মদপুর এলাকায় এখন রাজীব যুবরাজ হিসেবেই পরিচিত।

২০১৪ সালে কাউন্সিলর হওয়ার পরই যুবলীগের এই নেতার অবস্থা বদলে যেতে থাকে। এই কয়েক বছরে তিনি শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে জানা গেছে। জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া গেছে তাঁর বিরুদ্ধে। রাজীবের সব অপকর্মের সঙ্গী যুবলীগ নেতা শাহ আলম জীবন, সিএনজি কামাল, আশিকুজ্জামান রনি, ফারুক ও রাজীবের স্ত্রীর বড় ভাই ইমতিহান হোসেন ইমতিসহ অর্ধশত ক্যাডার।

শনিবার বিকেলে সরেজমিনে মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটিতে গিয়ে কথা হয় খান শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তাঁর বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন রাজীব। তিনি বলছিলেন, ‘রাজীব আমার বাড়িতে বছর দুয়েক ছিলেন। এখন আমার গলির তিনটি গলির পরই রাজীব নিজেই বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। এমন বাড়ি আমাদের হাউজিংয়ে আর নেই।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, কাউন্সিলর রাজীবের বাবা তোতা মিয়া হাওলাদার মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটি ও চান মিয়া হাউজিং এলাকায় তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। এর মধ্যে রাজীব মেজো। পেশায় রাজমিস্ত্রি বাবার সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি রাজীব মোহাম্মদীয়া সুপার মার্কেটে টং দোকানও করেছেন।

এই মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, অবৈধভাবে প্লট ও জমি দখল করে বিক্রি করে টাকা কামিয়েছেন রাজীব। এ ছাড়া দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বিত্তের মালিক হয়েছেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, বসিলা এলাকার পরিবহনে চাঁদাবাজি রাজীবের নিয়ন্ত্রণে। অটোরিকশা, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও বাস থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তোলে তাঁর লোকজন। পাঁচ বছর ধরে এলাকার কোরবানির পশুর হাটের ইজারাও নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন রাজীব।

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে আল্লাহ করিম মসজিদ ও মার্কেটের নিয়ন্ত্রণও রাজীবের হাতে। কাউন্সিলর হওয়ার পর মসজিদ ও মার্কেট পরিচালনা কমিটির সভাপতি করেন তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই ইকরাম হোসেনকে। অভিযোগ রয়েছে, সভাপতি হয়েই ইকরাম মসজিদ মার্কেটের আয় নানাভাবে হাতিয়ে নেন। মার্কেটের ৩৯টি দোকান বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করছেন তিনি।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭