ইনসাইড থট

কোন প্রত্যাশায় পরিবহন ধর্মঘট!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/11/2019


Thumbnail

২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে সংসদে আইন পাস করা নতুন পরিবহন আইনের বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়াই তা বাস্তবায়ন বা প্রয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। যদিও আইনের অস্পষ্ট বিষয়গুলো স্পষ্ট করার জন্য বিধিমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জানা গেছে যে, নতুন সড়ক পরিবহন আইনের ৪ নম্বর ধারাটি ড্রাইভিং লাইসেন্স সংশ্লিষ্ট। এ ধারার ৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘মোটরযানের শ্রেণি বা ক্যাটাগরি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে।’ ঠিক একইভাবে মোটরযানের নিবন্ধন, ফিটনেস সনদের মেয়াদ, গণ-পরিবহনের চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট)সহ আরও বেশ কিছু ধারায়ও বিধির কথা বলা আছে। তাই বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়া এই আইন পুরোপুরি কার্যকর করতে যারা পরামর্শ সরকারকে দিয়েছেন তাঁরা আসলে কী চান তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে।

মালিকদের রাতারাতি বড় লোক হবার মানসিকতা: পরিবহন ব্যবসায় খুব দ্রুত টাকা কামানো যায় এটা এই খাতে বিনিয়োগ ইচ্ছুকদের দৃঢ় বিশ্বাস। এমন অনেকেই আছে যারা একটা দুইটা মিনিবাস দিতে ব্যবসা শুরু করেন ১০/১৫ বছরে বিশাল পরিবহন বহরের মালিক। সদ্য বহিষ্কৃত এক আওয়ামী লীগের এক নেতা ২০০৯ সালে ঢাকায় ২/৩ টা গাড়ি নিয়ে ‘বিহঙ্গ’ নামে পরিচালিত তাঁর পরিবহন একটি রুট নিয়ে শুরু করে ব্যবসা। গত বছর পর্যন্ত পাঁচটি রুটে ২৪০টি বাস চলছে তাঁর কোম্পানির। এমন হলে কে না এই ব্যবসায় আসতে চাইবেন! এটা তো সোনার খনি!

গাড়ির সংখ্যা হঠাৎ বাড়ার গোপন রহস্য পরিবহন মালিক সমিতির চাঁদাবাজি বলে অনেকেই মনে করেন। সাথে তাঁরা পরিবহন শ্রমিকদের দিয়ে করেন বেশুমার চাঁদাবাজি, যার মাশুল গোনেন সাধারণ মানুষ, গরীব বা মধ্যবিত্ত মানুষ। এই খাতে প্রতিদিন কোটি টাকা চাঁদা উঠে বলে বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় খবর এসেছে।

গাড়ি প্রতি দৈনিক আয়ের বা সীমা বেঁধে দেওয়া মালিকদের আরেকটি কৌশল। এতে পরিবহন শ্রমিকরা দৈনিক জমার টাকা উঠাতে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে উৎসাহিত হন। কারণ তা না হলে তাঁদের না খেয়ে থাকতে হয়। নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে গেলে সব দিন দৈনিক জমার টাকা উঠাতে পারা যায় না। এতে করেই অনেক সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সাধারণ পথচারী। অবশ্য নাগরিকদের সচেতনতাও অনেক ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। শিক্ষিতজনদের অনেকেই আছেন যারা জেব্রা ক্রসিং বা ফুট ওভার ব্যবহারে আগ্রহী নন, যা সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ। এমন আরও অনেক কারণ আছে সব বলতে গেলে অনেক কথা বলা দরকার। যেমন ফিটনেস-বিহীন গাড়ি আর রাস্তার বেহাল দশাতেও অনেক সময় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান রাস্তার পাশে নিরাপদ ও নির্ধারিত স্থানে থাকা পথচারী, কিংবা ঘুমন্ত মানুষ। এমন খবর আমরা অনেকেই জানি।

দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে যেভাবে পরিবহণের বা যানবাহনের সংখ্যা বাড়ে যেই গতিতে কিন্তু দক্ষ চালকের সংখ্যা বাড়ে না। তাই ‘প্রয়োজন কোন আইন মানেন না’ ধরে নিয়ে জেনেশুনে পরিবহন মালিকগন অপেশাদার বা অদক্ষ বা আধা-দক্ষ চালক নিয়োগ দেন। অনেক সময় বাঁচার প্রয়োজনে চালকেরাও ভুয়া অভিজ্ঞতা দেখিয়ে ভুয়া লাইসেন্সে চাকরী নেন। আবার এমন ঘটনাও আছে যে, দক্ষ চালকেরা তাড়াতাড়ি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য লাইসেন্স প্রাপ্তির বিআরটিএ’র দীর্ঘ প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত করতে দালালের মাধ্যমে বিআরটিএ’র কর্তাদের ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স নেন। কিন্তু লাইসেন্সে সই স্বাক্ষর সব ঠিক থাকলেই তা বিআরটিএ’র নথিতে বা সার্ভারে থাকে না।, ফলে তা অবৈধ হয়ে যায়। ‘যত ভালো গাড়ি চালাতে পারেন না কেন টাকা না দিলে শতকরা ১০ ভাগের বেশী আবেদনকারী কখনোই লাইসেন্স পান না’ বলে অভিযোগ আছে। বিআরটিএ’র কর্তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও একেবারে কম না। বিআরটিএ’র কর্তাদের একটা বিরাট অংশের মানুষের আছে উপনিবেশিক মানসিকতার। তাঁদের দাপ্তরিক সংস্কৃতিই ভিন্ন সেখানে আম জনতা থেকে ব্যবসায়ী সবাই তাঁদের গোলাম, তাঁরা ব্রিটিশ সাহেব। একই অবস্থা পুলিশ বাহিনীর ট্রাফিক বা হাইওয়ে শাখায়। তাঁদের বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য অনেক সময়ই পরিবহণ শ্রমিকদের লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়ে থাকেন। যারা নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করেন তাঁরা নিজেরাই এই ঘটনার শিকার হননি, তা নয়। আমাদের দেশে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি মানবিক পুলিশ বাহিনী বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মানুষ দরকার। অনেক চালক অভিযোগ করেন যে, সকালে গাড়ি নিয়ে বের হলে বিশেষ বাহিনীর কিছু মানুষকে নাস্তার টাকার যোগান দিতে না পারলে মামলা হয় বায়বীয় অভিযোগে।

গণপরিবহন বা বাণিজ্যিক পরিবহণের শ্রমিকগন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দৈনিক হাজিরায় কাজ করেন। পরিবহন শ্রমিকদের চাকরীর অনিশ্চয়তা এই সেক্টরে অস্থিরতার অন্যতম একটি কারণ। তাঁদের দাবি হচ্ছে অসচেতন মানুষ হঠাৎ রাস্তায় দ্রুতগামী গাড়ির সামনে এসে পড়লে দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না। কিন্তু নতুন আইনে তাঁর কোন প্রতিকার নেই। ফিটনেস-বিহীন গাড়ি চালাতে বাধ্য করা হায়, যার দায় মালিকদের, শাস্তি পান শ্রমিকরা। দৈনিক জমার পরিমাণ এমন করেই নির্ধারণ করেন মালিকগন যাতে ট্রাফিক আইন ভেঙ্গে গাড়ি চালানো ছাড়া অনেক সময় উপায় থাকে না। যন্ত্রচালিত দ্রুতযান চলার লেনে যন্ত্র-হীন যানবাহন ঢুকে পড়ে কিংবা স্বেচ্ছাচারী লেন পরিবর্তনকারী চালকের কারণেও অনেক দুর্ঘটনা হয়। পরিবহন মালিক সমিতির গাড়ির চালকদের এই আচরণ বেশী দেখা যায়। মালিকের চাকরী তাই যখন ইচ্ছা তখন মালিক তাঁদের ছাটাই করতে পারেন, তাঁদের চাকরীর কোন নিশ্চয়তা নেই। সরকারীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কোন ব্যবস্থা নেই যাতে তাঁরা অবসরকালীন সময়ে পরিবার তো দুরের কথা স্বামী-স্ত্রী দুবেলা খাবার পাবেন এমন নিশ্চয়তা নেই।

অনেক পরিবহন ব্যবসায়ি আছেন যাদের অন্য অনেক ব্যবসা আছে। সেই সব ব্যবসায় অধিক মুনাফার জন্য পরিবহন শ্রমিক নেতাদের ম্যানেজ করে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই সব ধরণের পরিবহন সেবা/ চলাচল বন্ধ করে রাখা হয়। সেখানে সুবিধাভোগী শ্রমিক নেতা আর কিছু মাস্তানদের ব্যবহার করা হয়। তাতে গণপরিবহন বা বাণিজ্যিক পরিবহণের নিরীহ শ্রমিকগন তাঁদের দৈনিক হাজিরা থেকে বঞ্চিত হয়ে না খেয়ে মরার দশায় পড়েন, এটা দেখার বা মনিটরিং করার জন্য সরকারী কোন ব্যবস্থা নেই। আর্থিক ছাড়াও রাজনৈতিক মুনাফার প্রত্যাশা থেকেও পরিবহণ শ্রমিকদের ব্যবহার করা হয়, ‘এটা ওপেন সিক্রেট’।

বাংলা ইনসাইডার/এমআরএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭