ইনসাইড ট্রেড

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি খেদাও আন্দোলন কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/12/2019


Thumbnail

মোগল সম্রাট নূর উদ্দিন মুহাম্মদ সেলিম এর অপর নাম জাহাঙ্গীর।  জাহাঙ্গীর পার্সিয়ান শব্দ যার বাংলা অর্থ বিশ্বজয়ী/ভুবনজয়ী এবং ইংলিশে “conqueror of the world”। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৫ থেকে ১৬২৭ প্রায় ২২ বছর ভারত শাসন করেছেন।  সম্রাট শাজাহান ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র যিনি তাজমহল নির্মাণ করে বিশ্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ ওই বাদশা জাহাঙ্গীরের নামেই। জাহাঙ্গীর নামটি বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ।  বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছিলেন ৭ সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর অফিসার। ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মহানন্দা নদীর পাড়ে যুদ্ধে শহীদ হন। এই মহান বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার নামে ঢাকা সেনানিবাসের মূল গেটের নামকরণ করা হয়েছে।

১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০২০ সালে ৫০ বছর পূর্ণ করবে। সম্প্রতি সময়ে সকলের প্রশ্ন কেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো আন্দোলন? কেন এখানে ভিসি খেদাও আন্দোলন। জাহাঙ্গীরনগরের কিসের অসুখ? দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও প্রশ্ন , আক্ষেপ , বিরক্তি এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে।

৬০ দিন বন্ধ ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় একটি নির্মম হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে। নিরপরাধ একটি তাজা প্রাণ কি নিপীড়নের শিকার হয়েছিল হায়েনাদের হাতে! সেই আবরার যেন জেগে উঠে জাহাঙ্গীরনগরে। জাহাঙ্গীরনগর শিহরিত হয়েছিল জুবায়ের হত্যাকান্ড থেকে। আবরার হত্যার বিষয়টি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে নাড়া দেয়। কারণ র‌্যাগিং এখানকার নিত্য দিনের সঙ্গী।

১৯৯১ সাল থেকেই আমরা জেনে আসছি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে র‌্যাগিং হচ্ছে। এমন অভিযোগে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে। আমাদেরকে মানতে হবে মানুষের সহ্য ক্ষমতা একটি মাত্র আছে।সেটি অতিক্রম করে গেলে কারো আসলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।প্রতিবাদে ফেঁটে পড়ে।সে তখন আন্দোলনে নামে, বিচার চায়।   

প্রথমত:  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য এই র‌্যাগিং বন্ধে খুব একটা সফলতার পরিচয় দেননি।

আনন্দের বিষয় হলো এখানে পরিবেশবাদী শিক্ষক অনেক। পরিবেশ বিজ্ঞান নামে একটি বিভাগ আছে। টেকসই উন্নয়নের উপর পিএইচডি করা দর্শনের অধ্যাপক আছেন। সে কারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শীতের পাখির এক অভয় অরণ্যও। এটি গৌরব করবার মতো বিষয়। প্রকৃতি প্রেমী নগরবাসি জাহাঙ্গীরনগরে আসে পাখিমেলা , প্রজাপতি মেলা দেখতে।

সেহেতু , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রত্যাশা উন্নয়ণ হবে জীববৈচিত্র বান্ধব টেকসই উন্নয়ণ । জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এখানে দাপট দেখান ওই সব তাত্বিক কিন্তু বাস্তব  বিষয়কে উপেক্ষা করে। বর্তমান উপাচার্য মহাপরিকল্পনা করেছেন ওই জীব বৈচিত্রকে মূল্য না দিয়ে।

টেকসই উন্নয়ন এর লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একজন বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন যাতে বাংলাদেশ ২০৩০ এ বিশ্ব দরবারে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দেন।  বিশ্ববাসী সেটা জানে কারণ তিনি জাতীয় বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে একটি ফান্ড তৈরী করেছেন। তিনি সেজন্য জাতিসংঘ থেকে সন্মান সূচক সনদ “চ্যাম্পিয়ন অফ টি আর্থ” পেয়েছেন। 

সেই টেকসই উন্নয়নের একটি মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো অংশীজনের সকলকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমান উপাচার্য সেখানে বিষয়টি দাপট দেখিয়ে উপেক্ষা করেছেন।

এরপর এসেছে মহাপরিকল্পনা অনুসারে টেন্ডার প্রক্রিয়া। সেখানে তিনি সুশাসনের অন্যতম দিক স্বচ্ছতাকে মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন টেন্ডার ছিনতাই এর খবর এবং ই -টেন্ডার দেয়ার নীতিমালাকে উপেক্ষা করে। এসব তিনি করছেন যাতে নির্ধারিত মেয়াদে ১৪৪৫ কোটি টাকা খরচ করে হল ও ভবন নির্মাণ করতে পারেন এবং সেগুলিতে নিয়োগ দিয়ে যেতে পারেন। এই তাড়াহুড়ো সকলের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে।

 

আরও মজার বিষয় হলো ওই সব টেন্ডার মূল্যায়নের জন্য এমন একজন অফিসারকে মনোনীত করেছেন যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটায় ভর্তি হয়েছেন এবং ২০০০ সালে পাশ করে কোনো লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা না দিয়ে এডহক এ উপাচার্যের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ২০০৯ সালে।  এরপর তিনি ২০১৫ সালে নিজের স্ত্রীকে আরো চারজনের সঙ্গে এডহক এ অফিসার হিসেবে নিয়োগ আদায় করতে সমর্থ হন বর্তমান উপাচার্যের আনুকূল্যে।

পত্রিকায় আরো খবর হলো তিনি নাকি এপর্যন্ত আরো ৫ জনের নিয়োগ প্রভাব খাটিয়ে আদায় করেছেন। শুধু তাই নয় ১০ বছরে তিনি ডেপুটি রেজিস্ট্রার।

বর্তমান উপাচার্য নিজের ক্ষমতা জাহির করতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানাকে বান্ধবী হিসেবে দাবি করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা হয়তো বিষয়টি আদেও জানেন না। প্রশাসন চলে ভারপ্রাপ্ত আর গণতন্ত্রকে কোরবানি দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে।     

একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল একমাত্র সেশনজট মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।সেই গৌরব ফিরে পেতে জাহাঙ্গীরনগর এখন অদম্য চেষ্টা করছে।  

বিশ্ববিদ্যালয় যেমন সর্বোচ্চ মানের জ্ঞান চর্চার জায়গা , তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ নৈতিকতা শিক্ষা ও চর্চার জায়গা।  এখানে গবেষণা কাজে পরপর দুটি শব্দ অন্যের লেখা থেকে একনোলেজ না করে নিলে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।  এখানে কোনো ছাত্র নকল করুক বা না করুক কাছে থাকলেই অপরাধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেজন্য বহিস্কার হতে পারে। এখানে যারা আছেন তারা কেবল মেধাবী নন, দৃঢ়চেতাও বটে। এক কথায় দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম নীতি।এখানকার সকলকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মর্যাদা দিতে আচার্য করা হয় প্রধানমন্ত্রী বা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের সাংসদদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন দ্বিতীয়বারের জন্য।  সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল ছাড়া অনির্বাচিত।  

যদি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কারো সঠিক ধারণা থাকে তবে সেখানে “কেন এতো  ভিসি খেদাও আন্দোলন?” প্রশ্ন অসার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন এমন ব্যক্তি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবকই নন , তিনি জাতির অভিভাবক , বরেণ্য ব্যক্তি।তাঁকে অবশ্যই সর্বোচ নৈতিকতা দেখাতে হবে কাজে ও আচরণে।

কিন্তু আমরা কি দেখেছি? দেখেছি বিজ্ঞাপন ও সাক্ষাৎকার ছাড়া একদিনে ৫ জনকে এডহক এ নিয়োগ দিতে। বাংলাদেশের চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  যিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আমার জানা মতে তিনি বিজ্ঞাপন ও সাক্ষাৎকার  ছাড়া এক সঙ্গে ৫ জনকে কেন- একজনকেও নিয়োগ দেননি।   

আমরা অনেকই মসজিদের ইমাম নির্বাচনের কথা জানি। সেখানে বলা আছে, যখন দুই ব্যক্তি সমান সমান ইমাম হওয়ার যোগ্য, তখন তাঁদের স্ত্রীরা কেমন দেখতে হবে।  ইমাম এমন ব্যক্তি হবেন যিনি প্রফেটদের গুণাবলী ধারণ করবেন। সমাজের দাবি ও আকাংখা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা প্রফেটের মতো শুদ্ধ থাকবেন। তাঁদের কাজে শুদ্ধাচার কৌশল প্রয়োগ একশতভাগ হতে হবে।  উপাচার্য কত মর্যাদার বাংলাদেশের সমাজে, কত উঁচুতে স্থান, তার উদহারণ আমরা কিছুদিন আগে টকশোতে দেখেছি যখন একজন উপাচার্য একটি দলের সভাপতি হতে যুক্তি দিয়ে রোষানলে পড়েছিলেন। 

কোনো উপাচার্য যদি ৮ তারিখ বলেন আলোচনা হয়েছে রাজনৈতিক, আর ৯ তারিখ বলেন হলের নির্মাণের টাকার থেকে কমিশন ভাগের আলোচনা হয়েছে, এবং সেটার পরিমাণ ৬% হতে হবে, তাহলে আর কি কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকলো ওই মহান পদে থাকবার? তিনি ছাত্রের কাছে এভাবেই কথা বলেছেন।

আপনারা আপনাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য যাঁদের হাতে সপে দেন তাঁদের নেতা উপাচার্য যদি সৎ না হন তাহলে আপনি বা জাতি সেখান থেকে কি আশা করতে পারেন?  মানব সন্তান কেবল একটি কম্পিউটার নয় বা রোবট নয় যে তাঁকে কিছু সফওয়ারে সমৃদ্ধ করলেই হলো - রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পাখিকে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে খাওয়ানোর মতো । শিক্ষা শব্দটার মানে আমরা বুঝি, কিন্তু ভুলে যাই।আমিও হয়তো ভুলে যাই।আমার ছাত্ররা সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়।আর এরই নাম বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে আমরা পরস্পরের গুরু-শিষ্য।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ বিশ্বমানের হতে পারেনি ওই উপাচার্যদের জন্য। তাঁরা অনেক সময় মেরুদন্ডহীনদের নিয়োগ দেয়। তাঁরা নিয়োগ দেয় সবচে মেধাবীকে বাদ দিয়ে সবচে কম মেধাবীকে। আদালত যাদের নিয়োগকে বাতিল করে, ওই উপাচার্যদের যখন জনগণ টকশোতে দেখে তখন ওই টেলিভিশন বন্দ করে দেয় সেটা কি তারা বোঝেন? দেশের উন্নয়ন খায় ঘুন পোকায়, আর বিশ্ববিদ্যালয় খায় দুর্নীতিবাজ উপাচার্যরা। তাদের এই কর্মকান্ড দেখে জাতি লজ্জা পায়! তাদের ক্ষমতার এতো লোভ যে আদালত রায় দিয়ে অবৈধ নিয়োগ ঠেকায়!

"দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়" সরকারকে সহায়তা দিতে আন্দোলন করে, কোনো ভিসি খেদাও আন্দোলন করে না। তাঁরা আন্দোলন করে দুর্নীতি নামক অসুখকে তাড়াতে, কোনো বরেণ্য উপাচার্যকে নয়। আর সেজন্য মিডিয়া তাঁদের পাশে দাঁড়ায়।

আমরা সকলে জানি কম্পিউটারকে নিয়মিত ভাইরাস মুক্ত করতে হয় যাতে সেটি ভালোভাবে কাজ করে। আন্দোলন হয় প্রশাসনকে দুর্নীতি মুক্ত করতে, উপাচার্যকে সাহায্য করতে। যখন তিনি এটা বুঝতে ব্যর্থ হন, তখন তিনি আন্দোলনকে ভয় পান এবং আন্দোলন সম্পর্কে অপ্রচার চালান।

জাহানগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক মানের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ ও স্টাফ কলেজের গভার্ণিং বডির সদস্য। সেখানে সেনাপ্রধান , বিমান বাহিনীর প্রধান , নৌবাহিনীর প্রধান থাকেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেখানে সভাপতি। সেজন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হতে হবে অনেক অনেক উঁচু মানের পরিশীলিত একজনকে। এখানে তাই জিরো টলারেন্স প্রযোজ্য! আর এজন্য জাহাঙ্গীরনগরে ভিসি খেদানো হয় না- আন্দোলন হয়  জাতিকে রক্ষা করতে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতাকে সুরক্ষা করতে।

 

লেখক: অধ্যাপক ডক্টর ফরিদ আহমেদ , দর্শন বিভাগ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭