ইনসাইড আর্টিকেল

রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে একদিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/12/2019


Thumbnail

সেই ইটের ভাটাটি আর নেই। সময়ের আবর্তে শহীদদের ওপর নির্যাতনের সাক্ষী বটগাছটিও হারিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রায়েরবাজারের সেই ইটভাটা আর বটগাছটির মাঝখানটিতেই দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ফেলে রেখেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা। নিঃশেষে প্রাণ দান করা সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তচিহ্নকে স্মরণ ও ধারণ করে সেই ইটভাটার আদলেই গড়ে তোলা হয়েছে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। বটগাছের আঙ্গিকে রোপণ করা হয় আরেকটি বৃক্ষ।

স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিসৌধ হল কোনো স্মৃতিকে জীবন্ত করে রাখার কংক্রিট উপায়। বাংলাদেশের বাংলাদেশ হয়ে ওঠার যে করুণ কাহিনীটি রয়েছে তাকে বাঙালির মনে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যা একটি স্পর্শকাতর ঘটনা। স্বাধীনতার জন্য বলি হওয়া অসংখ্য শহীদের স্মৃতি ধারণ করে আছে দেশের বধ্যভূমিগুলো। এরই মধ্যে অন্যতম ঢাকার রায়েরবাজার বদ্ধভূমি।

এখন যেমনটা আছে রায়ের বাজার বধ্যভূমি

সাড়ে ছয় একর জায়গার ওপর নির্মিত এই স্মৃতিসৌধের প্রধান প্রবেশপথ চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। এপথে প্রবেশ করলেই প্রথমে চোখে পড়ে একটি বটগাছ। এই বটগাছ নিকটবর্তী শরীর-শিক্ষা কলেজ প্রাঙ্গণস্থ আদি বটগাছের প্রতীকরূপ। আদি বটগাছের নিচে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে প্রথমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে পরে ইটখোলায় নিয়ে হত্যা করা হতো। চিরসবুজ বটগাছটি ছাড়া অন্য যেসব গাছ সৌধের চত্বরে লাগানো হয়েছে, সেগুলির পাতা প্রায় ঝরে গেছে। ডিসেম্বরে মাসে পত্রহীন গাছগুলো যেন ১৪ ডিসেম্বরের শোকানুভূতিকে আরও আবেগময় করে তোলে। তাছাড়া সৌধের চারদিকে বেশকিছু কৃষ্ণচূড়ার গাছ রয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল হয়তো শহীদের রক্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সৌধটির প্রধান অংশটি হলো বাঁকানো দেয়াল। বাঁকানো দেয়ালটি দুদিকে ভাঙা। ভগ্ন দেয়াল দুঃখ ও শোকের গভীরতাকে নির্দেশ করে। দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটি বর্গাকার জানালা রয়েছে। সেই জানালা দিয়ে পেছনের আকাশ দেখা যায়। দেয়াল ঘেঁষে সম্মুখভাগে রয়েছে একটি স্থির জলাধার। জলাধারের ভেতর থেকে কালো গ্রানাইট পাথরের একটি স্তম্ভ উঠে এসেছে ওপরের দিকে।  

প্রতীকিভাবে চিন্তা করলে দর্শনার্থী যেন ফিরে যায় সেই একাত্তরে, ঘৃণা জানায় বর্বরোচিত সেই হত্যাকাণ্ডের। বক্র দেয়ালের সামনেই ১৬ হাজার ৬০০ বর্গফুটের একটি কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে। এ জলাশয় থেকেই উঠে এসেছে ৩৩ ফুট উঁচু একটি কালো স্তম্ভ, যা এখানে আসা দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের সেই কালোরাতগুলোতে। এ সৌধ কেবলই কোনো স্মৃতিসৌধ নয়, মহাকালের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের এক রোমহর্ষক স্মৃতি।

কবস্থানটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মী মো. আলমগীর বলেন, ‘রায়েরবাজার কবরস্থানটির এলাকায় আগে মানুষের চলাচলে ভয় ছিল। এখন কবরস্থান নির্মাণের কারণে অত্যন্ত সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে কয়জন সদস্য রয়েছেন, তা পর্যাপ্ত নয়। সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার।’

সেই রোমহর্ষক স্মৃতি

রায়েরবাজার। এক সময় এই এলাকার নাম শুনলে রাজধানীর ঢাকার সব মানুষের গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠতো। স্বাধীনতার পরবর্তী এক দশকে রাতের বেলা দূরের কথা, দিনেও মানুষ সেখানে চলাচল করতো ভয়ে ভয়ে। রায়েরবাজারের বধ্যভূমির চারদিকে পাওয়া যেত মানুষের খুলি আর হাড়গোড়। এরপর ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে সেখানকার জনজীবনের চিত্র। পাল্টে গেছে রায়েরবাজারও। মুক্তিযুদ্ধের সেই ইতিহাস সংরক্ষণ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্মৃতিসৌধ।

একাত্তরের ডিসেম্বরের হেমন্তের স্নিগ্ধ এক সকালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিধনের দুঃখ ভারাক্রান্ত খবরটি ভেসে আসে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ও তাদের এদেশিয় দোসর রাজাকার-আলবদররা হত্যা করে দেশের শ্রেষ্ঠসন্তান বুদ্ধিজীবীদের। ওই সময় দখলদার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে এবং বাঙালির বুকে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগানোর পেছনে বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রেরণা রয়েছে মনে করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করার নোংরা প্রয়াশে লিপ্ত হয়। স্বাধীনতার মাত্র একদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য শিক্ষক ড. মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, শিল্পী আলতাফ মাহমুদসহ বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে আলবদর ও রাজাকাররা। হত্যার পর রায়েরবাজারের নিচু ডোবায় লাশ ফেলে দেয় ঘাতকরা। এখানে ঢাকার অন্যান্য এলাকা থেকে হত্যা করা মৃতদেহ এনে ফেলত হানাদার বাহিনী।

স্থপতির গল্প

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার এ নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার স্থানে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকটস্ যৌথভাবে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রণয়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আহবান করে। ২২টি নকশার মধ্যে স্থপতি ফরিদউদ্দীন আহমেদ ও স্থপতি জামি-আল-শফি প্রণীত নকশাটি নির্বাচিত হয়। গণপূর্ত বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব লাভ করে। এ কাজ ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিন বছর সময়ে সম্পন্ন হয়।

পূর্ত তথ্য মতে, সমগ্র স্থানটি ৩.৫১ একর আয়তনবিশিষ্ট। এটি ১৫.২৪ মিটার বর্গাকার একটি গ্রিড দ্বারা বিভক্ত হয়েছে। মূল বেদিটি রাস্তা থেকে ২.৪৪ মিটার উঁচু। স্মৃতিসৌধের প্রধান অংশটি ১৭.৬৮ মি উঁচু, ০.৯১ মি পুরু ও ১১৫.৮২ মি দীর্ঘ একটি ইটের তৈরি বাঁকানো দেয়াল।

সৌধচত্বরে একটি ছোট জাদুঘর, অফিস কক্ষসহ একটি পাঠাগার এবং একটি কবরস্থান নির্মাণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে। 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭