ইনসাইড আর্টিকেল

মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধে তারাই সফল?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/12/2019


Thumbnail

হিটলারের নাৎসি পার্টির রাজনৈতিক দর্শন ছিলো- একটি জাতিকে যদি অনুগত ও পদানত রাখতে হয়, তাহলে তাদের স্বাধীনমনা ও আদর্শনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের আগে নিপাত করো, হিটলারের জার্মানিতে তাই টমাস মান থেকে শুরু করে অসংখ্য সাহিত্যিকের বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। অনেককে হত্যা এবং অনেককে জেলে ঢোকানো হয়। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিক রোমা রলা হিটলারের কারাগারেই বসে লিখেছিলেন। "I will never rest" (আমি ক্ষান্ত হব না।) ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমি ক্ষান্ত হবো না।

ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর রাজত্বের সময়ে অসংখ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আলবার্তো মোরাভিয়া দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে দশ বছর পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পাকিস্তানে আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনের সময়ে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত রাইটার্স গিল্ডের সভায় আলবার্তো মোরাভিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং লিখেছিলেন “আমি দ্বিতীয় মুসোলিনীর দেশে আসতে চাই না।”

পাকিস্তানি বাহিনী এবং এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তান পন্থীরা উপলব্ধি করেছিল যে, মুক্তিযুদ্ধে সফল অভিযানের পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের মতোই যারা বুদ্ধি, প্রেরণা, উৎসাহ এবং বাঙালির স্বাজাত্যবোধ সম্পন্ন সাংস্কৃতিক চেতনায় উজ্জীবিত করেছেন তারা বেঁচে থাকলে সেইসব দেশদ্রোহীদের পক্ষে এই দেশের মাটিতে টিকে থাকা দুষ্কর। তাই পেশাজীবী বাঙালির নানা স্তরের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ওপর নেমে আসে ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিত গুপ্তহত্যার নিষ্ঠুর আক্রমণ। পাকিস্তানের দোসররা আরো চিন্তা করেছিল এইসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমেই স্বাধীনতা পেতে যাওয়া বাঙালিকে একটি পঙ্গু জাতিতে পরিণত করা সম্ভব। তাই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় তথা স্বাধীনতা লাভের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর রাতে চূড়ান্ত হত্যকাণ্ড চালানো হয়।

স্বাধীনতার পরের গল্প থেকেই যদি শুরু করি। গত ৪৯ বছরে বহু আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাইরে এসব কর্মকাণ্ড হয়েছে ইসলামি জঙ্গিদের দ্বারা। জঙ্গিদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছে উদীচীর মতো সংগঠন ও ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। আক্রান্ত হয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কবি শামসুর রাহমান, মুক্তিযোদ্ধা আমান, ড. রায়হান রশীদের পরিবার, আসিফ মহিউদ্দিন, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী আরিফ নূরের মত মানুষরা। জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, অধ্যাপক এম তাহের, অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম লিলন, বগুড়ার প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবু, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুক, যুবলীগ নেতা জগতজ্যোতি তালুকদার, লিফটম্যান জাফর মুন্সীর মতো আলোকিতজন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন জীবননাশের হুমকি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, এরফলে কয়জন গ্রেপ্তার হয়েছে? তাদের বিচার কতটা দৃশ্যমান?

জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলাম (হুজি), হিজবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম– যে নামই বলা হোক না কেন, এই সকল সংগঠনের মূলে রয়েছে জামাত। নানা সময়ে গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে জামাতের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা। হুজি কমান্ডার মোহাম্মদ ইউনুস স্বীকার পেয়েছেন জামাত জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং দলটি অর্থ, সাহস, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করত। জামাতের সঙ্গে যোগ হয়েছে হেফাজত। নারীদের নিয়ে নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য

১৯৭১ সালে মূল শত্রু ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। আজকে আমাদের মূল শত্রু সে সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দেশীয় দোসর জামাত ও তার মতাদর্শ ইসলামি জঙ্গিবাদ। পরিস্থিতি এবার ভিন্ন। তারা প্রস্তুতি নিয়েছে, যেমন বাঙালিরা প্রস্তুত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের আগে। আর এদিকে আমরা প্রস্তুতিহীন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা মুখে মুখে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও তা অনুশীলন করেন না; এ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনায় অংশগ্রহণ করে জনগণকে সম্পৃক্ত করেন না; সমাজতন্ত্র নিয়ে আলাপ তো সুদূরপরাহত।

তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে। একদিকে আমরা যেমন অপ্রস্তুত হয়ে বসে আছি, অন্যদিকে জামায়াত-ই-ইসলামী বিএনপির ছায়াতলে থেকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আঘাত করছে আমাদের মূল পরিচয়ে। তারা বিভ্রান্ত করছে বহু মানুষকে ‘ধর্মীয় অনুভূতির’ কথা বলে। স্বাধীন মত প্রকাশকারী আলোকিত মানুষদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে তারা। ‘আইরনি’ হচ্ছে এই যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে গড়ছে সরকার, কিন্তু তার সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিবাদী শক্তি। ফোনে ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করে ‘বাঁশের কেল্লা’ জানিয়ে দিচ্ছে চাঁদে নাকি দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মুখ দেখা গিয়েছে। তারা বুঝাতে চাচ্ছে, নাস্তিক বা ভিন্নমতাবলম্বীরা মানুষ নয়, তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই, তাদের কোপাতে হবে। হিন্দু-বৌদ্ধদের মন্দিরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া জায়েজ।

একাত্তরের পরাজিত শত্রু রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীরা এখনো ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। ধর্মের নাম দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী সংগঠনগুলো।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭