ইনসাইড আর্টিকেল

ঘাতকের সঙ্গে লড়াই: প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/12/2019


Thumbnail

যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী, রাজাকার। যে নামেই একাত্তরের কলংকময় শত্রুদের ডাকা হোক না কেন, এদের অপরাধের ওজন এক। গত ৪৮ বছরে এদের শিকড় ঘন হয়েছে গভীরে।

অনেকে তারকা খচিত রাজাকারদের ফাঁসী কার্যকরের পর স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছে। শত্রুর মাথা ভেঙে ফেলার পর আর শক্তি কোথায় ভেবে সহজ জীবন যাপন করছে। আমার কখনও তা মনে হয় না। এ পর্যন্ত যেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং রায় কার্যকর হয়েছে তারা রেখে যাচ্ছে তাদের বংশধর।

অগণিত ভক্তকুল। প্রাচুর্যের পাহাড়। তাদের অর্থের বিনিয়োগে পাওয়া যায় স্কুল, মাদ্রাসা, পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, কোচিং সেন্টার, এতিমখানাসহ বহু কিছু। এমন কি দেশী বিদেশী নামকরা লবিস্ট, ব্লগার, সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের অহরহ দেখা যায় তাদের পক্ষে কাজ করতে। লড়াই করতে। বিশাল অর্থের বিনিময়ে।

ক্ষমতা, অর্থ, বিত্তে প্রচণ্ড প্রভাবশালী এই যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে আমাদের লড়াই থেমে যাওয়ার নয়। এদের অর্থে ক্রয়কৃত শক্তি সদা ব্যস্ত দেশকে অস্থির, অরাজকতাময় আর নিরাপত্তাহীনতায় রাখবার জন্য।

১৯৭১ সালে বিজয়ের মাত্র দু`দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন ও মেধাশূন্য করতে হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। তাঁরা এক অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, যা আজ তাঁদের সন্তানরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বুদ্ধিজীবীদের যে লক্ষ্য ছিল সেখান থেকে তাদের সন্তানদের এক চুলও বিচ্যুতি ঘটেনি।

বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরির ছেলে আসিফ মুনির, শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে সাংবাদিক শাহীন রেজা নুর, জাহীদ রেজা নূর, শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. এএফএম আবদুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী, শহিদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ, শহিদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার সন্তান শমী কায়সার, সুমন জাহিদ শহিদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভিনের ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার ফজলুর রহমানের ছেলে সাইদুর রহমান, শামসুল করিম খানের মেয়ে ফাহমিদা খানমসহ বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা গড়ে তুলেছেন ‘প্রজন্ম ৭১’ নামে একটি সংগঠন। ১৯৯১ সালের ২৯শে অক্টোবর ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের করে আত্মপ্রকাশ ঘটে সংগঠনটির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধের দাবি জোরদার করা এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল। উনিশ, বিশ, একুশ, বাইশ এমন বয়স ছিল যখন তারা এই সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সংগঠনের বয়স প্রায় ২৮ বছর হয়ে গেছে। বিভিন্ন আন্দোলনে পথে থেকেছেন এর সদস্যরা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখার মূল উদ্দেশ্যে নিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে যোগ হয়েছে আরো লক্ষ্য। কিন্তু এই সংগঠনের লক্ষ্যের কতটা অর্জন হয়েছে? তাদের সেই অর্জনগুলোতে বাধাও হচ্ছে একটা পক্ষ। সেটা কোন পক্ষ?

স্বাধীনতার ৪৯ বছরে পা দিয়ে স্পষ্টতই একটা লড়াই আমাদের চোখে পড়ার কথা। যে লড়াইটা শুরু করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। যাদের মধ্যে ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমদ, আবুল খায়ের, ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার, শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ডা. আজহারুল, ডা. আমিন উদ্দিন, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, আনোয়ার পাশা, ড. ফজলে রাব্বী, নাজিমুদ্দিন আহমেদ, শহীদ সাবের, সেলিনা পারভিন, গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, ড. আবুল কালাম আজাদসহ অনেকে। অনেকের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এবং অনেকের লাশ পাওয়াও যায়নি যারা একটা স্পষ্ট শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন।

কারা তাদের হত্যা করেছে? পাকিস্তানি দালালরা। দালাল বলতে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসকে বুঝানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আলবদর ছিল আক্ষরিক অর্থেই ডেথ স্কোয়াড। তারা সরাসরি মাঠে ময়দানে গিয়ে লড়েনি, বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট কিলিংই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তারাই ছিল সবচেয়ে বেশী তৎপর এবং এদের সাহায্যেই পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করেছে, তারাই এসে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং পরিশেষে হত্যা করেছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছে নিজামী মুজাহিদরা।

এই মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ১৯৭১ সালে ঘৃণিত অপরাধের জন্য। আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল গোলাম আযমকে। আর আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে। এই দুই জন রায়ের বিরুদ্ধে পৃথক আপিল করেছিলেন। কিন্তু কারাগারেই তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। ফলে তাদের আপিল অকার্যকর হয়ে গেছে। চিহ্নিত এসব শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যদের ফাঁসি কিংবা দণ্ড দেওয়া হলেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সন্তানরা।

কি সেই লড়াই? তাদের পিতাদের যে আদর্শ ছিল সেই আদর্শ বাস্তবায়নে সব সময়ই একাট্টা তারা। দেশে বিদেশে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীদের সন্তানরাই বারবার বাধাগ্রস্থ হয়েছেন। কাটিয়েছেন কষ্টের জীবন। কিন্তু তাদের লক্ষ্য অটুট ছিল বলে আজ শিক্ষিত ও এই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। বিপরীতে যুদ্ধাপরাধীদের অঢেল সম্পত্তির জোরে দেশে বিদেশে পড়াশুনা করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সন্তানরাও।

মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য যারা সারা দিন-রাত ওয়াজ নসিহত মায়া-কান্না করে সেই জামাত নেতাদের সন্তানরা কেউ মাদ্রাসায় পড়েনি। তারা পড়ে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ কেউ আবার উচ্চশিক্ষা নিতে তাদের ভাষায় ইহুদি নাসারা দেশ ইউরোপ আমেরিকায় গিয়েছে।

জামায়াত নেতা নিজামীর চার ছেলে ও দুই মেয়েসহ মোট ছয় সন্তান। ছোট ছেলে নাদিম তালহা এখনও ছাত্র হলেও বাকি পাঁচ সন্তানই প্রতিষ্ঠিত। দেশে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সঙ্গেই জড়িত তার বেশিরভাগ সন্তানরা। তারা পড়াশুনা করেছে পাকিস্তান ও মালেয়েশিয়াতে। মানবতাবিরোধী আন্তজার্তিক ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে রয়েছে তাদের ব্যাপক বিরোধিতা। প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ট্রাইব্যুনালবিরোধী বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান নিজামীর সন্তানরা।

নিজামীর স্ত্রী সামসুন্নাহার নিজামীও পিছিয়ে নেই। তিনি গুলশানে একটি ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে জামাতের নারী শাখার আমিরের দায়িত্ব পালনকারী নেত্রীও নিজামীর স্ত্রী সামসুন্নাহার নিজামী।

গোলাম আযমের ছয় ছেলের একজনও মাদ্রাসায় পড়েননি। চতুর্থ ছেলে আব্দুল্লাহ হিল আমান আল আযমী ২০০৯ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে কর্মরত অবস্থায় অবসরে যান। গোলাম আযমের ছেলেদের তৎপরতা নিয়ে নানা সময়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। তারা সরাসরি সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে যুক্ত।

আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের সন্তানরা কেউ আছেন অস্ট্রেলিয়ায় কেউ লন্ডনে। কাদের মোল্লার সন্তানরাও উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন।

মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সন্তানরা দেশে ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। জামাতের ফান্ডের অর্থায়নও করেন তারা। মীর কাশেম আলী হলো জামাতের অর্থ যোগানদাতার শীর্ষনেতা ধনকুবের। ছেলেমেয়েরা পাকিস্তান ও আল মানারাত থেকে পাস করেছেন। যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর সন্তানরাও বিদেশে অবস্থান করছেন।

এদের প্রত্যেকের লক্ষ্য একটাই। তাদের পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। বুদ্ধিজীবীরা  যে জন্য লড়াই করেছেন তাদের সন্তানরাও সেভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামাত নেতাদের সন্তানরা হয়ে পড়েছে কোনঠাসা। কিন্তু অর্থ প্রতিপত্তি দিয়ে প্রতিনিয়ত দেশে বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষে মনোনয়ন দিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে বিএনপিসহ তাদের নতুন রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু বিএনপি বহু বছর ধরেই তাদের মদদ দিয়ে আসছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে।  একাত্তরে ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এমন অনেককেই গেল নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ নিজ এলাকায় আলবদর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত আবদুল আলীমের ছেলে ফয়সাল আলীম মনোনয়ন পেয়েছেন জয়পুরহাট-১ আসন থেকে। একাত্তরে এলাকায় রাজাকার কমান্ডার ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ড পেয়ে পলাতক আসামি আব্দুল মোমিন তালুকদার। তার স্ত্রী মাসুদা মোমিন তালুকদারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বগুড়া-৩ আসন থেকে। অন্যদিকে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর পুত্র শামীম বিন সাঈদীকে ধানের শীষে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে পিরোজপুর-১ আসন থেকে। মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমানও নির্বাচন করছেন এবার।

 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭