নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 14/01/2020
স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশে আমৃত্যু নিবেদিত একটি সত্ত্বা সেলিম আল দীন। কঠিন সময়ে নিরন্তর দেশপ্রেম ও সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যের ধারায় পথ হেঁটে বাঙালির শিল্প-সাহিত্যধারাকে তিনি পৌঁছাতে চেয়েছেন শিল্প-সাহিত্যে আত্মমর্যাদার অনন্য বৈশিষ্ট্যে। আজ সেলিম আল দীনের ১১তম প্রয়াণদিবস, ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। তাঁর অকাল প্রয়াণে বাংলাদেশের সংস্কৃতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আজকের এ দিনে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁকে।
‘সেলিম আল দীন’ তাঁর শিল্পী নাম। প্রকৃত নাম মু. মঈনুদ্দিন। ক্ষণজন্মা শিল্পপুরুষ সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট্ট কালপর্বে তাঁর রচিত নাট্য-সাহিত্য, নাট্য ইতিহাস ও শিল্পতত্ত্ব বাংলাদেশী জাতিসত্তায় চিরদিন অবিস্মরণীয়।
সেলিম আল দীন প্রধানত গবেষণা, নাট্যরচনা, তাত্ত্বিক ভিত্তি চিহ্নিতকরণ, নাট্য নির্দেশনা এবং শিক্ষকতায় মধ্য দিয়ে মতাদর্শের বিকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি উপনিবেশের বিভ্রান্তি-আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ইতিহাসের সত্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। প্রচলিত ইতিহাসের বিভ্রান্তির বিরূদ্ধে তিনি প্রামাণিক তুলে ধরেন- বাঙলা নাটকের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো।
সেলিম আল দীনের পরিণত রচনাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চূড়ান্তভাবে উপনিবেশের জ্ঞানতত্ত্ব, প্রকরণ বিন্যাসকে উপেক্ষা করা এবং হাজার বছরের চর্চিত ধারার বিকাশ ঘটানো। বিষয়ে যেমন আশ্রয় করেছেন হাজার বছরের বহমান বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি। তেমনি রচনারীতিকে বাঙালির আবহমান সাহিত্য ঐতিহ্যকেই জাতীয় সাহিত্যচর্চায় অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করতেন। বাংলার চিরায়ত সাহিত্যরীতিকে সেলিম আল দীন ধারণ করেছিলেন মনেপ্রাণে এবং সমকালীন শৈল্পিকতার বিবেচনায়। উপনিবেশের সামগ্রিকতা এমনকি বিরামচিহ্নকেও তিনি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছে- ‘মুনতাসির’ ‘শকুন্তলা’ ‘কিত্তনখোলা’ ‘কেরামতমঙ্গল’ ‘হাতহদাই’ ‘চাকা’ ‘যৈবতী কন্যার মন’ ‘প্রাচ্য’ ‘বনপাংশুল’ ‘হরগজ’ ‘নিমজ্জন’ ‘ধাবমান’ ‘স্বর্ণবোয়াল’ ‘ঊষা উৎসব’ ‘পুত্র’ ইত্যাদি।
সাহিত্যদর্শনেও বাংলার বহমান ধারাতেই তিনি ছিল সক্রিয় এবং স্বকীয়। তাঁর রচনাগুলো হাজার বছরের বাঙালির জীবন সংস্কৃতির ধারায় সিক্ত। পাশ্চাত্যের জ্ঞানতত্ত্বের বিপরীতে সুসমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ধারায় বাংলা নাটকের গতিকে করেছেন ত্বরান্বিত। গবেষণা তত্ত্বেও এনেছে পরিবর্তন।
সেলিম আল দীন বিভিন্ন নাটকে উপস্থাপন করেছেন হাজার বছরের গ্রাম্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য বোধ-বুদ্ধি ও ভাষার মাধ্যমে নিপুণ করে। তিনি নাটকে রেখেছেন- টিনের বাঁশির হুইসেল, বায়োস্কোপ, যাত্রার প্যান্ডেল, কাককাড়ুয়া, চটের বেড়া, চুড়ির পসরা, কবিগান, খেলনার দোকান, ঔষধ বিক্রেতা, পটচিত্র, বয়াতি, নকশা করা পিঠা ইত্যাদি। যা গ্রাম্য বাঙলার সংস্কৃতিতে স্থান দখল করে রেখেছে হাজার বছর ধরে।
শুধু তাই নয়, নাটকের চরিত্রগুলোর নামকরণেও রেখেছেন একই ধারা। কেরামত, অধর, আকিন, শরমালি, দশরথ, সায়েবালি, আজমত, সোনাই, বছির, ছমির আলী, সুবল ঘোষ, ইদু, মংলা, শামছল, রুস্তম, ছায়ারঞ্জন, কেরামত, অখিলদ্দি, ছবর, জালু, মির্জা, অধর, আকিন, শরমালি, দশরথ, সায়েবালি, আজমত, খালেক, মোহাদ্দেস, ডালিমন প্রভৃতি চরিত্র বর্তমানের বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে নিয়মিত বসবাসরত মানুষের ব্যক্ত রূপ ও নাম।
‘কেরামতমঙ্গল’ নাটকের প্রসঙ্গে গেলে দেখা যায় কেরামতের জীবন প্রবাহের মধ্য দিয়ে এ নাটকটিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সমাজ, সভ্যতা ও বাস্তবতাকে। এতে আছে হাজংদের আন্দোলন এবং বাঙলায় ধর্মীয় আগ্রাসনের চিত্র।
‘কেরামতমঙ্গল’ নাটকের শুরুতেই কেরামত কাকতাড়ুয়া বানাতে বানাতে বলে:
‘মলকা বানুর দেশেরে। বিয়ার বাদ্য আল্লা বাজে রে। কাককাড়ুয়ার সাথে কথা কিরে বেডা মলকা বানুর দেশে যাবি না আমাগো মুগ খেতে খারায়া খারায়া পক্ষী তাড়াবি। হে হে হে। আইচ্ছা থাইক তরে আগে মুন মিয়ার হাজ পোশাক দিয়া নুই।’
কেরামতমঙ্গল নাটকটিতে তিনি গ্রামীণ খাদ্যের নাম উল্লেখ করেছেন। মুড়ি, কোঁচ, হুকা, হাস্তর কওয়া, গাজন, জিওল মাছের ঝোল, কদমা, মহরমের গান, পাকা শরবি কলা ইত্যাদি যা বাঙলার চিরায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
সমুদ্র উপকূলবর্তী আঞ্চলিক মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নাটক ‘হাত হদাই’। এ নাটকে বাঙলার আঞ্চলিক জীবন প্রস্ফুটিত। এ নাটকের চরিত্র মোদু ও আনার ভারির কথোপকথনে ভিন্ন ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সেলিম আল দীনের কথানাট্যরীতির আরেকটি নিরীক্ষাধর্মী ‘যৈবতী কন্যার মন’।
এ নাটকেও তিনি ঔপনিবেশিক সাহিত্যধারাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যধারাকে বিকশিত করার কাজে লিপ্ত হন। বাংলা নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পরীতিও এ নাট্যে প্রায়োগিক আখ্যানে একীভূত করেন। এ নাটকের প্রতিটি বর্ণনা-কথোপকথনের মধ্যে বাঙালি সমাজ- সভ্যতার চিত্র দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। বর্ণনাত্মক ধারা বাঙালির মধ্যযুগে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এ নাটকে ভিন্ন কালের বাঙালি নারীজীবনের যন্ত্রণাকে বেঁধেছেন তিনি একই আবহে।
বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭