ইনসাইড আর্টিকেল

ত্রয়োদশ পর্ব: জেল যেন দ্বিতীয় বাড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 21/01/2020


Thumbnail

আগামী ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সরকার ২০২০ এর ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ এর ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে। ১০ জানুয়ারি থেকে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে। ১০ জানুয়ারি হলো জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এই মহামানবের জীবন, বেড়ে ওঠা, রাজনীতি এবং বাঙালির জাতির পিতা হয়ে ওঠার যে গল্প তা তিনিই তার বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি, অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং ডায়রিতে লিখে গেছেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করে মুজিববর্ষে বাংলা ইনসাইডারের এই বিনম্র নিবেদন:

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি জেলে আসলাম। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়েছে। আমার তিনবার জেলে আসতে হল, এইবার নিয়ে। মওলানা সাহেবের কাছে সকল কিছুই বললাম। মওলানা সাহেব এক এক করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কি বলেছেন? পীর মানকী শরীফের মতামত কি? মিয়া সাহেব রাজনীতি করবেন কি না? নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন হবে কি না? হলে, কতদিন লাগবে? লাহোরে কোথায় ছিলাম? ঢাকার খবর কি? মওলানা সাহেবের কাছে শুনলাম, আমাদের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করা হয়েছে। মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব, আবদুর রব, ফজলুল হক বিএসসি ও আমি আসামি। আবদুর রব ও ফজলুল হককে জামিন দিয়েছে। নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে নাই, তাই তারা বাইরে আছে। মামলা শুরু হয় নাই, কারণ আমাকে গ্রেফতার করতে পারে নাই। নাজিরা বাজারে পুলিশের সাথে ১১ই অক্টোবর তারিখে যে গোলমাল হয় তার উপর ভিত্তি করেই মামলা দায়ের করেছে।

যে কামরায় আমরা আছি সেখানে আমরা তিনজন ছাড়াও কয়েকজন ডিভিশন কয়েদি আছে। এদের কয়েকজনের বিশ বৎসর জেল, আর কয়েকজনের অল্প শাস্তি হয়েছে। এদের আর্থিক অবস্থা ভাল বলে সরকার ডিভিশন দিয়েছে এবং এরাও আমাদের মত খাট, মশারি, বিছানা, সাদা কাপড় পায়। এদের মধ্যে একজন ম্যানেজার আছে, সে আমাদের বাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা এবং দেখাশোনা করে। আমাদের দিন ভালভাবেই কাটছিল। শামসুল হক সাহেব আমার উপর খুব রাগ করেছিলেন। কারণ, কেন আমি শোভাযাত্রা করতে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শোভাযাত্রা না করলে তো গোলমাল হত না। আর আমাদের জেলে আসতে হত না এই সময়।

শামসুল হক সাহেব মাত্র দেড় মাস পূর্বে বিবাহ করেছিলেন। হক সাহেব ও তাঁর বেগম আফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। একে অন্যকে পছন্দ করেই বিবাহ করেছিলেন। আমাকে বেশি কিছু বললে আমি তাকে বউ পাগলা’ বলতাম। তিনি ক্ষেপে আমাকে অনেক কিছু বলতেন। মওলানা সাহেব হাসতেন, তাতে তিনি আরও রাগ করতেন এবং মওলানা সাহেবকে কড়া কথা বলে ফেলতেন। মওলানা সাহেবের সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিল। শামসুল হক সাহেবকে নিয়ে বিপদ হত। এক ঘণ্টার কমে কোনো নামাজই শেষ করতে পারতেন না। এক একটা সেজদায় আট-দশ মিনিট লাগিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে বসে থাকতেন।

আমাদের মামলা শুরু হয়ে গেছে, পনের দিন পর পর কোর্টে যেতে হত। কোর্ট হাজতের বারান্দায় আমাদের চেয়ার দেওয়া হত। তাড়াতাড়ি আমাদের আবার পাঠিয়ে দিত।

অনেক সহকর্মী আমাদের সাথে দেখা করতে আসত। ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রায় তারিখেই আসত। আতাউর রহমান সাহেব আমাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতেন। যেদিন হক সাহেবের সাথে তার বেগম দেখা করতে আসতেন, সেদিন হক সাহেবের সাথে কথা বলা কষ্টকর হত। সত্যই আমার দুঃখ হত। দেড় মাসও একসাথে থাকতে পারল না বেচারী। একে অন্যকে যথেষ্ট ভালবাসত বলে মনে হয়। আমি বেগম হককে ভাবী বলতাম, ভাবী আমাকেও দু’একখানা বই পাঠাতেন। হক সাহেবকে বলে দিতেন, আমার কিছু দরকার হলে যেন খবর দেই। আমি ফুলের বাগান করতাম। তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম। হক সাহেব জেলের আবদ্ধ অবস্থা আর সহ্য করতে পারছিলেন না।

 

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

(পৃষ্ঠা নং- ১৬৮ থেকে ১৬৯)

চলমান……

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭