ইনসাইড থট

হঠকারী বিশ্ব রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 23/01/2020


Thumbnail

চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা আতঙ্কের মধ্যেও আশাব্যঞ্জক কিছুও রয়েছে! যে বিষয়গুলো বিশ্ববাসীকে বর্তমান সময়ে সর্বাধিক আতঙ্ক উৎকন্ঠায় রেখেছে সেগুলো হচ্ছে ১) জলবায়ু বিপর্যয় ২) মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা এবং ৩) তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পদধ্বনি!

পরিবেশ বিপর্যয় ইতোমধ্যেই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অচিরেই এবং কোনো যুদ্ধ বিগ্ৰহ ছাড়াই এই সুন্দর পৃথিবী টা জনমানবশূন্য প্রাণহীন গ্ৰহে পরিণত হবে। অস্ট্রেলিয়া পুড়ছে দাবানলে। এর এমন ভয়াবহ রূপ ইতোপূর্বে আর দেখা যায়নি। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বনভূমি ছাড়াও আশপাশ এলাকার বাড়িঘরও ভস্মীভূত হচ্ছে। তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছুটে গিয়ে জড়ো হচ্ছে সাগর নদীতীরে। অস্বাভাবিক জলবায়ুর বিরূপ প্রক্রিয়ায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে ঝড় জলোচ্ছ্বাস। ইতোমধ্যে গত ১৯ জানুয়ারী একদফা ভারী শীলা বৃষ্টিসহ ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেছে। তারপরও দানবীয় দাবানল কমেনি। কত কোটি প্রাণী মারা পড়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো মেলেনি। কয়েক মাস আগে ইউরোপজুড়ে তীব্র তাপ প্রবাহ বয়ে গেছে। ফ্রান্সে পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙেছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৫.৯° সেলসিয়াস (১১৪.৬২° ফারেনহাইট)! অচল হয়ে পড়েছিল জীবনযাত্রা। কিন্তু মি. ট্রাম্প এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেই থামেন নি। ২০১৭ সালেই তিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করে প্যারিস চুক্তি থেকে একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। সমগ্ৰ বিশ্বের মানুষ যেখানে- জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আতঙ্কিত বিক্ষুব্ধ এবং সোচ্চার, এমনকি, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরই বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যে ঝড় জলোচ্ছ্বাস উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে এবং ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে সমুদ্র সৈকত, বসতি এলাকা এবং বনাঞ্চল- সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত কি পৃথিবীবাসীর সঙ্গে এক নির্মম হঠকারিতা নয়? আশার কথা হ`ল- মাইক্রোসফট কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে যে তারা যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করছে তার চেয়ে বেশী পরিমাণে তারা কার্বন শোষণ করবে। প্রযুক্তি সুবিধা গ্ৰহন করে অন্যরাও অভিন্ন নীতি অনুসরণ করলে নিশ্চয়ই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধের পথ প্রশস্ত হবে।

উপসাগরীয় অঞ্চলে একটি যুদ্ধ বেঁধে গেলে আমাদের গায়ে আঁচ লাগবেনা- কোনো অর্বাচীন কিম্বা উন্মাদও এমনটি ভাববে না। সমুদ্র ঝড়ে পর্যুদস্ত জাহাজের যাত্রী শ্রীকান্তের (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) ভাষায়, "জাহাজসুদ্ধ সবাই যে পাতালের রাজ বাড়িতে নিমন্ত্রন খাইতে চলিয়াছি, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এখন ভাবনা শুধু এই যে, খাওয়া-দাওয়া টা তথায় কি জানি কিরূপ হইবে।" আমাদের ক্ষেত্রে ভাবনার বিষয়টি হচ্ছে- কী প্রক্রিয়ায় আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ হবে! আমাদের দেশে কেউ হয়ত বোমা ফেলে বোমার অর্থ জলে ফেলতে আগ্ৰহী হবে না। কিন্তু কারো অনিচ্ছায়ও হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত `Little Boy` কিম্বা `Fatman` এর চেয়ে হাজার গুন বিধ্বংসী আনবিক বোমা অথবা ডজন ডজন ক্ষেপণাস্ত্রের মুহুর্মুহু আঘাতে একটি একান্ত শান্তিপ্রিয় নিরপেক্ষ ছোট্ট দেশ অগ্নিগোলকের রূপ ধারণ করবে না অথবা সাগর তলের যাদুঘরে সংরক্ষিত হবেনা তা বলার উপায় নেই। এই কথার প্রমাণ তো হাতের কাছেই আছে। উদাহরণ: ১) ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানি হত্যার বাদলা নিতে গত ৮ জানুয়ারী শেষ রাতে ইরাকের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ২২টি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানে ইরান। আমেরিকা পাল্টা আক্রমণ চালাবে এটা প্রায় অবধারিতই ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। অথচ ওই ঘটনার অর্থাৎ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ৬ ঘন্টা পরে ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্স এর একটি যাত্রীবাহী বোয়িং বিমান তেহরান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই পর পর দুইটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তেহরানের আকাশে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটির ক্রু-মেম্বারসহ সর্বমোট ১৭৬ জন আরোহীর সকলেই নিহত হন। ওই ভাগ্যবিড়ম্বিত বিমানটিকে মার্কিন বিমান ভেবে এর উপর ভুল বসতঃ ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালানো হয়েছিল! উদাহরণ: ২) ২০১৬ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্যের একটি সাবমেরিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূলের কাছাকাছি থেকে পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম একটি ট্রাইডেন্ট মিসাইল আফ্রিকার দক্ষিণ পূর্ব দিক নিশানা করে পরীক্ষামূলকভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। কিন্তু উৎক্ষেপণের পর এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিক পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হয়। ভাগ্যবসত পরীক্ষামূলক হওয়ার কারণে এতে কোনো পারমাণবিক বিস্ফোরক ছিলনা। বৃটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা জেরেমি করবিন এই ঘটনাকে মহা বিপর্যয়কর আখ্যায়িত করে বলেন যে যদি ওই মিসাইলে পরমানু অস্ত্র থাকতো তবে কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারতো তা কল্পনা করাও কঠিন। এমন ঘটনা আরো আছে। এআই(AI= Artificial Intelligence) নিয়ন্ত্রিত আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র সমুহ প্রায়ই অটোমেটেড। এখানে ভুল রিডিং বা ভুল সংকেতের কারণে পৃথিবীতে যেকোনো মুহূর্তে মহা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জন্য আনবিক বোমা সমুহের বোতাম সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার তথা প্রেসিডেন্টের টেবিলে সংরক্ষিত। এখানেই বড় সমস্যা! এখন তো নির্বাচিত অনেক নেতার সিদ্ধান্ত-কর্মকাণ্ড নিজ দেশের ভিতরে যেমন বিপজ্জনক, দেশের বাইরেও ততোধিক বিপজ্জনক!

যুক্তরাষ্ট্র- ইরান যুদ্ধ আমেরিকার সুমতির কারণে এড়ানো গেছে- ব্যাপারটা সম্ভবত তেমন নয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে স্বদেশে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে(House of representatives) অভিসংশন প্রস্তাব পাশ হয়ে গত ২১-০১-২০২০ থেকে উচ্চ কক্ষ সিনেটে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এমন একটি সময়ে সিনেটকে পাশ কাটিয়ে জাতিসংঘের অনুমোদন ব্যতিরেকে একক সিদ্ধান্তে যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছিল না। তাছাড়া ইরানের সাথে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানির কৃত চুক্তি থেকে একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া, ইরানের উপর পুনরায় নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা এবং নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করণে চুক্তিভুক্ত অপর সদস্যদের উপর চাপ সৃষ্টির কারণে একমাত্র বৃটেন ব্যতিত আর সকলেই ক্ষুব্ধ। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ২৯ টি দেশের সামরিক জোট ন্যাটো`র(NATO= North Atlantic Treaty Organisation) নেতৃস্থানীয় দেশ ফ্রান্স জার্মানির সঙ্গে বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে। NATO এখন অনেকটাই প্রাণহীন, নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। সঙ্গত কারণে অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। এমতাবস্থায় এককভাবে এক্ষণে ইরানকে হাল্কাভাবে নিতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ ইরানের সাথে আপাতত যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রায় নেই। তবুও মানুষটি ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে কথা! কখন কী করে বসেন বলা কঠিন। আর যুদ্ধ বাঁধলেও তা ইরানে বা শুধু উপসাগরীয় এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবেনা। আর আমরা না খেয়ে যত না মরবো, পরমাণু তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে মরবো তার চেয়ে বেশী! অবশিষ্ট কজন থাকে বাকী- কী জানি!

জাকির হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেল সুপার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭