ইনসাইড আর্টিকেল

১৬তম পর্ব: আওয়ামী লীগ গঠন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 24/01/2020


Thumbnail

আগামী ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সরকার ২০২০ এর ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ এর ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে। ১০ জানুয়ারি থেকে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে। ১০ জানুয়ারি হলো জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এই মহামানবের জীবন, বেড়ে ওঠা, রাজনীতি এবং বাঙালির জাতির পিতা হয়ে ওঠার যে গল্প তা তিনিই তার বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি, অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং ডায়রিতে লিখে গেছেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করে মুজিববর্ষে বাংলা ইনসাইডারের এই বিনম্র নিবেদন:

মওলানা ভাসানী, আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমায়, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হলাম। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্ররা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন প্রাণ দিয়ে রুখে দাঁড়াল। দেশের মধ্যে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। শাসনযন্ত্র শিথিল হয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। বেকার সমস্যা ভীষণভাবে দেখা দিয়েছে। শাসকদের কোন প্ল্যান প্রোগাম নাই। কোনোমতে চললেই তারা খুশি। পূর্ব বাংলার মন্ত্রীরা কোথাও সভা করতে গেলে জনগণ তাদের বক্তৃতা শুনতেও চাইত না। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা কেউই ভুলে নাই। আমরা তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র করতে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলাম। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না মেনে নিলে আমরা কোনো শাসনতন্ত্র মানব না। এসময় ফজলুর রহমান সাহেব আরবি হরফে বাংলা লেখা পদ্ধতি চালু করতে চেষ্টা করছিলেন। আমরা এর বিরুদ্ধেও জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কোনো কোনো মুসলিম লীগ নেতা এককেন্দ্রিক সরকার গঠনের জন্য তলে তলে প্রপাগান্ডা করছিলেন। আওয়ামী লীগ ফেডারেল শাসনতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে প্রচার শুরু করে জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল।

বিনা বিচারে কাউকে বন্দি করে রাখা অন্যায়। ফলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। প্রগতিশীল যুবক কর্মীরাও আওয়ামী লীগে যোগদান করতে আরম্ভ করছিল। ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন হবে। ঘোষণা করা হল। আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ রইল না। গণতান্ত্রিক দল’ নামে একটা রাজনৈতিক দল করা হয়েছিল, তা কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জনাব এ, কে, ফজলুল হক সাহেব তখন পর্যন্ত এডভোকেট জেনারেল ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের। পাকিস্তান হওয়ার পরে আর তিনি কোনো রাজনীতি করেন নাই। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এডভোকেট জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। মুসলিম লীগের মধ্যে তখন কোন্দল শুরু হয়েছিল ভীষণভাবে। মোহন মিয়া সাহেব নূরুল আমিন সাহেবের বিরুদ্ধে গ্রুপ সৃষ্টি করেন এবং হক সাহেবকে মুসলিম লীগের সভাপতি করতে চেষ্টা করে পরাজিত হন। কার্জন হলে দুই গ্রুপের মধ্যে বেদম মারপিটও হয়। নূরুল আমিন সাহেবের দলই জয়লাভ করে, ফলে মোহন মিয়া ও তাঁর দলবল লীগ থেকে বিতাড়িত হলেন।

এরপর আমি হক সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে অনুরোধ করলাম। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি যোগদানও করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, “যাঁরা চুরি করবেন তারা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যারা ভাল কাজ করতে চান তারা আওয়ামী লীগে যোগদান করুন। আমাকে ধরে জনসভায় বললেন, “মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারব না, বুড়া মানুষ।” এ বক্তৃতা খবরের কাগজেও উঠেছিল।

এই সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে সেই পুরাতন গ্রুপ যুক্তফ্রন্ট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আবদুস সালাম খান, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন ও আরও কয়েকজন এজন্য প্রচার শুরু করলেন। এদিকে তথাকথিত প্রগতিশীল এক গ্রুপও বিরোধী দলের ঐক্য হওয়া উচিত বলে চিল্কার আরম্ভ করলেন। অতি প্রতিক্রিয়াশীল ও অতি প্রগতিবাদীরা এই জায়গায় একমত হয়ে গেল। কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল তখন ছিল না–একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া—যার নাম জনসাধারণ জানে। ভাসানী সাহেব ও আমি পরামর্শ করলাম, কি করা যায়। তিনি আমাকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলেন, যদি হক সাহেব আওয়ামী লীগে আসেন তবে তাঁকে গ্রহণ করা হবে এবং উপযুক্ত স্থান দেওয়া যেতে পারে। আর যদি অন্য দল করেন তবে কিছুতেই তার সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করা চলবে না। যে লোকগুলি মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছে তারা এখন হক সাহেবের কাঁধে ভর করতে চেষ্টা করছে। তাদের সাথে আমরা কিছুতেই মিলতে পারি না। মুসলিম লীগের সমস্ত কুকার্যের সাথে এরা ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জড়িত ছিল। এরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতাও করেছে। মওলানা সাহেব আমাদের অনেকের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আমাকে বলে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সদস্যদের মধ্যে যেন যুক্তফ্রন্ট সমর্থকরা মাথা তুলতে না পারে।

ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হল। বেশি সংখ্যক সদস্যই যুক্তফ্রন্টের বিরোধী। কারণ, যাদের সাথে নীতির মিল নাই, তাদের সাথে মিলে সাময়িকভাবে কোনো ফল পাওয়া যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে ঐক্য থাকতে পারে না। তাতে দেশের উপকার হওয়ার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা এই একতা চাচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্য মুসলিম লীগকে পরাজিত করা এবং ক্ষমতায় যে কোনোভাবে অধিষ্ঠিত হওয়া। ক্ষমতায় না গেলে চলে কেমন করে, আর কতকাল বিরোধী দল করবে।

পৃষ্টা ২৪৩ থেকে ২৪৫; অসমাপ্ত আত্মজীবনী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

চলমান……

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭