ইনসাইড বাংলাদেশ

১৪ ফেব্রুয়ারি; ভুলে যাওয়া দিপালী আর জয়নালদের কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/02/2020


Thumbnail

কলা ভবন থেকে শিক্ষা ভবন অভিমুখে ছাত্রদের মিছিল... স্লোগানে মিছিলে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়... সামরিক শাসন মানিনা... মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল কর... করতে হবে... হঠাৎ করেই গুলিতে প্রকম্পিত চারিদিক... মিছিলে পুলিশে ট্রাক তুলে দিয়ে শুরু হয় বর্বরতার এক ভয়াল নিদর্শন। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের হিংস্র পুলিশ বাহিনির উন্মত্ততায় একে এক লুটিয়ে পরে জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহা। আহতদের আহাজারীত হাসপাতাল গুলোতে তৈরী হয় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের... কলাভবনেও গুলি টিয়ার সেলের আঘাতে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নৃশংস হামলা। গ্রেফতার হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা.. কারফিউ জারি। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন শুধু জয়নালের লাশ পাওয়া গিয়েছে। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে। ১৫ই ফেব্রুয়ারী সারাদেশে হরতাল। সেদিন কাঞ্চন চট্টগ্রাম শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আরো অনেকে নিখোঁজ হন। তাদের জীবিত বা মৃত কোনও অবস্থায়ই পাওয়া যায়নি।

সে সময় সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান ক্ষমতায় এসেই নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে। এই নীতিতে দরিদ্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে ছাত্ররা এর প্রবল বিরোধিতা করে। ১৯৮২ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো ঐকমত্যে পৌঁছে।

এরই ধারাবহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির জন্ম। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি ও গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলটি হাইকোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ে এবং ছাত্রনেতারা তারের ওপর উঠে বক্তৃতা শুরু করে। এসময় পুলিশ বিনা উস্কানিতে তারের একপাশ সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে দিয়ে রঙ্গিন গরম পানি ছিটাতে থাকে, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয় জয়নাল। এরপর গুলিবিদ্ধ জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।

এসময় দিপালীও গুলিবিদ্ধ হন এবং পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি খুনি বাহিনী। কিছু না ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, এমন অপপ্রচার চালিয়ে সামরিক সরকার উস্কে দেয় পুলিশকে। ঐদিন নিহত হয়েছিল জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরো অনেকে। সরকারী মতেই গ্রেফতার করা হয় ১,৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি ছিল। খোঁজ মেলেনি অনেকেরই।

এই ঘটনার জোয়ার লাগে চট্টগ্রাম শহরেও। মেডিক্যাল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ ও গুলি চালালে নিহত হয় কাঞ্চন। ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি স্থগিত হয়ে যায়।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর এটাই ছিল ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ছাত্রবিক্ষোভের এবং নিপীড়নের ঘটনা।

গেল এক সপ্তাহ ধরেই ফেসবুক খুব জমকালো। সবাই বাহারি রঙের পোশাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ফালগুনকে। এর সঙ্গে সঙ্গে আবার কিছুটা এগিয়ে থাকছে ভালোবাসা দিবসের প্রস্তুতির খবর। এর মধ্যে কেউ হয়তো সাদাকালো দুটা ছবিও নিজেদের ফেসবুক ওয়ালে টানাবে। ছবিগুলো এক ভুলে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে যেন।

১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন’স ডে হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। খুব বেশি দিন না হলেও এখন বাংলাদেশ খুব ঘটা করে এটি পালন করা হয়। পহেলা ফালগুনের সঙ্গে ‘ভালোবাসা’ দিবসের বেচা-কিনিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ক্রেতা বিক্রেতা সবাই। আমরা সবাই এখন পণ্য, আমাদের যাপিত জীবনের বিশেষ দিনগুলোও পণ্য। আরও খোলাসা করে বলতে হয়, আমরাই আসলে হয়ে গেছি বাজারি। অথচ এই ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এই দিনটিকে পালন করা হতো ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে। অথচ এখন হয়তো আঠারোতে ভর করা নতুন প্রজন্মর অনেকেই জানে না বাংলাদেশে এমন একটি ঐতিহাসিক দিন আছে। আমরা নিজেদের ভাসিয়ে দিই ভালোবাসা দিবসের বাণিজ্যিক জোয়ারে, অথচ আমাদের করার কথা ছিল অন্য কিছু। আমাদের মনে রাখার কথা জয়নাল, দীপালিকে। একযুগও লাগেনি আমাদের সেই দিনের ইতিহাস মুছে বাণিজ্যিক বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে বুকে টেনে নিতে।

ইতিহাস নিজে বেঁচে থাকে না। একে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কোনও ঘটনা ইতিহাস হয় আর কোনোটি হয় না সেটিই ইতিহাসের বড় রাজনীতি। আমরা নিজ থেকে কোনও কিছু ভুলি কিংবা নিজ থেকে কোনও কিছু মনে রাখি– বিষয়গুলো আপাতভাবে এতো নিরীহ নয়। কোন ঘটনাকে আমরা মনে রাখবো আর কোনটি আমাদের ভুলিয়ে রাখা হবে সেটাও একটা রাজনীতির অংশ। আমাদের ক্রমশই ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে প্রতিবাদের ইতিহাসকে স্মরণ করা থেকে।

ভ্যালনটাইন দিবসের বিপক্ষে নয়, কারণ এই দিবসেরও সূচনা হয়েছিল একটি নৃশংস ঘটনার স্মারক হিসেবে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের সময়ে সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২৭০ খ্রি. রাষ্ট্রীয় বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে সম্রাট তার মৃত্যুর আদেশ দেন। সম্রাট খেয়াল করেছিলেন অবিবাহিত যুবকরা বিবাহিত যুবকের চেয়ে যুদ্ধের কঠিনতম মুহূর্তে ধৈর্যের পরিচয় দেয়; তাই বিয়ে প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেন্ট ভ্যালেনটাইন সম্রাটের এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ও গোপনে বিবাহ প্রথা চালু রাখেন। তাকে জেলে দেওয়ার পর সেখানে এক অন্ধ মেয়ের চিকিৎসা করে ভালো করেন। পরে তিনি মেয়েটির প্রেমে পড়েন। মৃত্যুর আগে মেয়েটিকে লেখা এক চিঠির শেষ বাক্য ছিল– ইতি তোমার ভ্যালেনটাইন।

আইন অমান্য করায় সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে হত্যা করায় রোমান সম্রাটের বিচার হয়নি ঠিকই, কিন্তু সেই ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ সারা বিশ্ব ওই ঘটনাকে স্মরণে রাখছে। কিন্তু আমরা কেন স্মরণ রাখতে চাই না আমাদের স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের বীর সৈনিকদের। আমরা কেন বলতে পারি না জয়নাল, দীপালি, জাফর, কাঞ্চনরাই আমাদের ভ্যালেনটাইন। এই দিবসে তাদের স্মরণ করাই তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার প্রকাশ। তারাই আমাদের ভ্যালেনটাইন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭