ইনসাইড বাংলাদেশ

কেঁচো খুঁড়তে সাপ; ভুয়া পরোয়ানা কাণ্ডে প্রথম আলোর প্রতিবেদক অরূপ রায়!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/03/2020


Thumbnail

ভুয়া পরোয়ানার চক্করে টানা ৬৮ দিন দেশের এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে কাটাতে হয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার আওলাদ হোসেনকে। জানতে পারেন নি, কি তার অপরাধ। একটি ‘মিথ্যা মামলায়’ জামিন না  হতেই নতুন কোন ‘গায়েবী মামলায়’ আবার পরোয়ানা! এভাবে এক জেল থেকে আরেক জেলে।

সীমাহীন হয়রানী থেকে মুক্তি পেতে শেষ মেষ ‘প্রতিকার চেয়ে’ উচ্চ আদালতের দারস্থ হন আওলাদ হোসেনের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন।

আদালতের সিদ্ধান্তে এ বিষয়ে নিবিড় তদন্ত শুরু করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। বেরিয়ে আসে কেচোঁ খুড়তে সাপ। এই চক্রের সাথে যুক্ত খোদ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় সাভারে কর্মরত নিজস্ব প্রতিবেদক অরূপ রায়।

সিআইডির প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়ার পর তাকেও আসামীর করে মামলা দায়ের করা হয় আশুলিয়া থানায়। এদিকে মামলা দায়েরের পর সিআইডি পুলিশ ভুয়া পরোনা কাণ্ডে জড়িত সন্দেহে সুমন নামের একজন আইনজীবী এবং আলমগীর নামে আরেক আসামীকে  গ্রেপ্তার করলে গা ঢাকা দেয় দৈনিক প্রথম আলোর ওই নিজস্ব প্রতিবেদক।

এ ঘটনা জানাজানি হবার পর রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কারণ গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ওই দৈনিকটিতেই ‘ভুয়া পরোয়ানার চক্করে আওলাদ, হাইকোর্টে স্ত্রী’ শিরোনামে প্রথম পাতায় গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রকাশিত হয়। তবে তখনো দৈনিকটির শীর্ষ ব্যক্তিদের জানা ছিলো না,এর নেপথ্যে খোদ তাদেরই এক কর্মির যুক্ত থাকার খবর।

দৈনিক প্রথম আলোর সাভারে নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত অরূপ রায় মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার রাধানগর গ্রামের প্রয়াত উৎপল রায়ের ছেলে। থাকেন ১৪৩/এ সাভার বাজার রোডের উত্তরপাড়ায়।

আগে তিনি দৈনিকটির মানিকগঞ্জে জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব ছিলেন। বিভিন্ন অনিয়মের কারনে পত্রিকাটির তৎকালীণ সাভার প্রতিনিধিকে বাদ দেয়া হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন অরূপ রায়। শ্বশুড়বাড়ি সাভারে থাকার সুবাদে সেখানেই জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধী চক্রের সাথে।

কেবল মাত্র বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া ওয়ায়েন্টে দিনের পর দিন নিরীহ মানুষকে জেলে পুরে হয়রানীই নয়, তথ্য অধিকার আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা আদায়,আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন জীবনযাপন, চাঁদাবাজী,নারী দিয়ে ফাসাঁনোসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে।

আর এসব অপকর্মে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাটির সাভার অফিসকেও যুক্ত করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতে নির্দেশে সহযোগীসহ অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে প্রতারণা করার উদ্দেশে আদালতের নথিপত্র সৃজন করা ও ‘আসল’ বলে তা ব্যবহার করে নিরীহ মানুষকে অন্যায়ভাবে আটক এবং পরস্পরের যোগসাজসে প্রতারণামূলক বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে আশুলিয়া থানায়।

ওই মামলার এজাহারে-ও সুস্পষ্টভাবে পত্রিকাটির সাভারের অফিসকে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

ফৌজদারী দন্ডবিধির ৪০৬/৪২০/৪৬৬/৪৬৮/৪৭১/৩৪৩/৩৪- ১৮৬০ ধারায় আশুলিয়া থানায় দায়ের করা মামলাটির নম্বর-৪০ তারিখ-১১/০২/২০২০।

মামলার বাদী আশুলিয়া থানার টাকসুর পশ্চিম পাড়ার মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে আওলাদ হোসেন।

তিনি জানান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে আশুলিয়ার বাইশমাইল এলাকায় প্রায় সাড়ে ১৭ শতাংশ জমি নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে সাভারের সৌদি প্রবাসী  দানেশ ঢালীর সঙ্গে আওলাদের বিরোধ চলে আসছিলো। সেই দানেশ ঢালীর সাভারের বাড়ির ভাড়াটিয়া অরূপ রায়। সেই বাড়ির তত্বাবধায়ক আইনজীবি সুমন আর দানেশ ঢালীর দুই ভাগ্নে দেলোয়ার ও জসিম এবং অপর ভাড়াটিয়া ফরহাদ ও হানিফ পরস্পরের যোগসাজসে ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করে এভাবে আমাদের হয়রানী করেছেন।

নিজের দু:সহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আওলাদ হোসেন জানান, গত বছরের ৩০ অক্টোবর হঠাৎ তাকে আশুলিয়া থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের সময় জানানো হয় তার বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়ারেন্ট এসেছে। কখনো কক্সবাজারে না গিয়েও কিভাবে সেখানে নারী নির্যাতন বা মানবপাচার মামলার আসামী হলেন তা ভেবেও কূল কিনারা পান নি তিনি।

এই মামলায় কারাগার থেকে মুক্তির আগেই তাকে জানানো হয়, বাগেরহাটের একটি আদালত থেকে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার আরেকটি ওয়ারেন্ট এসেছে। তাকে নেয়া হয় বাগেরহাটে। সেখানেও প্রমানিত হয় পরোয়ানাটি ভুয়া।

সেখান থেকে মুক্তি পেতে না পেতে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় শেরপুর আদালতের একটি ফৌজদারি মামলায়। পাঠানো হয় শেরপুরে।

আওলাদের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন বলেন, এভাবে রাজশাহী ও ঢাকায় পর পর পাঁচটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুর্বিসহ করে তোলা হয়েছিলো আমাদের জীবন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট প্রশান্ত কুমার মজুমদার প্রথমে এই ভুয়া ওয়ারেন্টগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। তার মতে, ‘‘প্রতিটি ওয়ারেন্টেই বিচারকের নাম, ওয়ারেন্টের নম্বর, সিল মোহর, ডেসপাস নম্বর সবই আছে৷ আর এই ওয়ারেন্ট যখন থানায় যায় তখন কারো বোঝার উপায় থাকে না যে, আসল না ভুয়া৷’’

এভাবে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার আওলাদ হোসেনকে টানা ৬৮ দিন এক জেল থেকে আরেক জেলে আটকে রাখার বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে রীট করা হয়।

বেআইনিভাবে আওলাদকে আটক রাখা হয়নি, তা নিশ্চিতে হাইকোর্টে হাজির করার জন্য নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর রিট করেছিলেন আওলাদের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন।

পরদিন ১০ ডিসেম্বর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার আওলাদ হোসেনকে ভুয়া ওয়ারেন্টে জড়ানোর ঘটনা তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

 বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে  রুলসহ এ আদেশ দেন।

এই প্রেক্ষিতে ভুয়া ওয়ারেন্ট কোথা থেকে ইস্যু হয় ও কারা ইস্যু করে তা খুঁজে বের করতে চার সদস্যের কমিটি গঠন করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

কমিটির সদস্যরা হলেন- সিনিয়র পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা, অতিরিক্ত এস এস পি ফারুক আহমেদ, সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মো. রেজাউল হক ও পুলিশ পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান।

সিআইডির প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়,অরূপ রায়ের সহযোগিতায় মামলার অপর আসামীরা পরস্পরের যোগসাজসে বিভিন্ন আদালতের বিচারকদের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া ওয়ারেন্ট বের করে আওলাদ হোসেনকে দিনের পর দিন আটকে রেখেছে।

পাশাপাশি এই জালিয়াতি কান্ডে স্থান হিসেবে মামলায় উঠে আসে দৈনিকটির সাভার অফিসকে ব্যবহারের বিষয়টি। 

 ওই মামলায় সুমন নামে একজন আইনজীবী এবং আলমগীর নামে অরূপ রায়ের এক সহযোগিকে সিআইডি গ্রেপ্তার করলে গা ঢাকা দেয় অরূপ রায়।

যোগাযোগ করা হলে সিআইডির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিচারের স্বাক্ষর জালিয়াতি কান্ডে অরূপ রায়ের সম্পৃক্তার প্রমান পাওয়া গেছে।অন্যান্য আসামীরাও তার নাম বলেছেন। এ ছাড়াও তার কল লিস্ট পর্যালোচনা করে তার নিবিড় সম্পৃক্ততার প্রমান মিলেছে।

পুলিশ সূত্রের খবর, অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে এর আগেও ঢাকা ও মানিকগঞ্জে চাঁদাবাজীর অভিযোগসহ নানা অভিযোগে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়।তবে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া ওয়ারেন্টে নিরীহ মানুষকে দিনের পর দিন আটকে রাখার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততায় বিস্মিত অনেকেই।

যোগাযোগ করা হলে, অরূপ রায়ের নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধি ও মানিকগঞ্জ জেলা  জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি,সাটুরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আইনজীবী আবদুল মজিদ ওরফে ফটো বলেন,আমার বয়স ৭৩।দুই বার বারের সভাপতি ছিলাম। অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে কিছু বলতে চাই না।রুচি নেই।নিজেকে যিনি সৎ সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন, তিনি কি করে এ ধরনের ঘটনায় সম্পৃক্ত হতে পারেন তা বোধগম্য নয়।

সূত্রমতে,২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি মানিকগঞ্জের ৪ নম্বর বিচারিক আদালতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সাইদুজ্জামান অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলা করেন।

 অভিযোগ করা হয়, সাটুরিয়ার পৌলসুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন নির্মাণকাজ চলাকালে প্রথম আলোর প্রতিবেদক অরূপ রায় ভবন নির্মাণস্থলে গিয়ে তাঁর কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। এর আগের বছরের ৫ ডিসেম্বর সাটুরিয়া উপজেলার কাউন্নারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে  পুনরায় তাঁর কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে অরূপ রায় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশসহ মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন।

 সাভার মডেল থানার একটি সূত্র জানায়,অরূপ রায়ের যাবতীয় কপকর্মের অন্যতম সহযোগী সাভারের ইয়াবা কারবারী আব্দুস সালাম রুবেল।তার মাধ্যমেই শীর্ষ দৈনিকটির পরিচয় দিয়ে  নিরীহ মানুষদের ব্ল্যাক মেইল করে ফাঁসানো ও ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের কাজ করে আসছিলো অরূপ রায়।

সাভারে একটি মার্কেটের দারোয়ান থেকে যুবদল হয়ে অরূপ রায়ের সহযোগী হিসেবে নাম লেখানো কুখ্যাত ইয়াবার সম্রাট আব্দুস সালাম রুবেলের ইয়াবা সেবনের একটি ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

সেই রুবেল সম্প্রতি চাঁদাবাজীর মামলায় গ্রেপ্তার হলে তাকে জামিনে বের করে আনেন অরূপ রায়। ফুল দিয়ে তাকে বরণ করে নেবার একটি ছবিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

অরূপ রায়কে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবী জানিয়েছেন সাভার প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিঠুন সরকার।

এর আগে তিনি অরূপ রায়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ঢাকার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসানের আদালতে।মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অরূপ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তিনি কোন কথা বলবেন না।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭