ইনসাইড থট

রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা না পেলে দায় কার?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 03/04/2020


Thumbnail

না। দৃশ্যটা আমি নিতে পারছি না। একজন মানুষ ঢাকা শহরে তার মা কিংবা বাবাকে নিয়ে রাতের বুক চিরে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন, কিন্তু কোথাও তাকে ভর্তি করতে পারছেন না। রাতের শেষ প্রহরে অনেক চেষ্টার পরে যখন তাকে একটি সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হল, তখন মৃত্যুর সার্টিফিকেট লেখা ছাড়া ডাক্তারের আর কিছু করার নাই। 

কেন এমন হলো? এর দায় কার?

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কারো জ্বর-সর্দি কিংবা কাশি হওয়া যেন অপরাধ। অথচ এখন ঋতু বদলের কাল, এই সময়ে জ্বর-ঠাণ্ডা-কাশির প্রকোপ এমনিতেই একটু বাড়ে। সমস্যা বাধিয়েছে আসলে করোনা। কোভিড আক্রান্ত রোগীর জ্বর, শুকনো কাশি এবং শ্বাস কষ্ট থাকে। তাদের চিকিৎসার জন্য সরকার নির্ধারিত একাধিক হাসপাতাল আছে। তবে সেসব হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে নভেল করোনা১৯ ভাইরাস পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। টেস্ট রিপোর্টে নিশ্চিত হওয়া ছাড়া উপসর্গের উপর নির্ভর করে সন্দেহভাজন কাউকে সেখানে ভর্তি করা হয় না। এর পক্ষে তাদের যুক্তিও ফেলনা না। একজন সাধারণ রোগীকে সেখানে ভর্তি করার ফলে দেখা গেলো সে কোভিড১৯ রোগীর সংস্পর্শে এসে এই অসুখটি বাধিয়ে ফেললো। এদিকে চাইলেই কেউ করোনার পরীক্ষা করতে পারবে না। সে আরেক কাহিনী! তিন মাস সময় পেলাম, তারপরও দেশে নভেল করোনা১৯ ভাইরাসের পরীক্ষার সুযোগ বাড়ালাম না। এর কারণ একমাত্র আল্লাহ এবং আইইডিএসআর জানেন। দুয়েকদিন আগে দেশের কয়েকটা শহরে করোনা পরীক্ষার সুযোগ তৈরী হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় যদিও তা এখনো অপ্রতুল। 

এখন কথা হলো, যাদের কোভিড১৯ এর মত জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্ট আছে অথচ করোনার জন্য টেস্ট করা নাই, তারা চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবে? বিশেষ করে রাতের বেলায় এই প্রশ্ন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। বেসরকারী ক্লিনিকগুলো অনেক ক্ষেত্রেই জ্বর-কাশি-শ্বাস কষ্ট থাকলে রোগীকে ভর্তি না করে অন্য কোন হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দিচ্ছে। সরকারী হাসপাতালগুলোতেও করোনার মত উপসর্গ থাকার কারনে সবসময় ভর্তি করছে না। ভর্তি না করার পেছনে তাদেরও শক্ত যুক্তি আছে। হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি থাকে, তাদের মধ্যে যদি কোন কোভিড১৯ রোগী ভর্তি করা হয়, তাহলে সেই রোগীর কাছ থেকে হাসপাতালের অন্য রোগী-ডাক্তার-স্বাস্থ্য কর্মীরাও সংক্রমিত হতে পারে। হাসপাতালে তো করোনা পরীক্ষা করার সুযোগ নাই, তাই রোগী কোভিড১৯ রোগে আক্রান্ত কি না, তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সুতরাং, বৃহত্তর নিরাপত্তার কথা ভেবে তারাও এসব রোগীকে অনেক সময় ফিরিয়ে দিচ্ছে। 

এদিকে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারার কারণে জনরোষ বাড়ছে। সব দোষ গিয়ে পড়ছে নন্দঘোষ ডাক্তারের উপর। সবার এক কথা, ডাক্তারদের তো পিপিই ( পিপিইর মান ও সংখ্যা নিয়ে এখানে কিছু লিখে ‘গুরুত্বপূর্ণদের’ আর লজ্জা দিতে চাই না) দেওয়া হয়েছে, তাহলে তারা কেন রোগী ভর্তি না করে ফিরিয়ে দিচ্ছে? কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে ডাক্তারদের একাত্তরের রাজাকারদের সাথেও তুলনা করছে। 

রোগী ভর্তি হবার বিষয়টা কি আসলেই ডাক্তারদের পিপিইর সাথে সম্পর্কিত? মোটেও তা নয়। ডাক্তার ব্যক্তিগতভাবে নিরাপদ হলেও পুরো হাসপাতাল পড়ে যেতে পারে করোনার ঝুঁকিতে। উপরের লেখাটুকু পড়লে তাই বোঝা যাবে, আসলে সবারই কাজের পেছনে যুক্তি আছে। মাঝখান দিয়ে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন কিছু মানুষ যা কোনক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না। এর থেকে তাহলে উত্তরণের উপায় কী? 

আমরা বেশ কয়েকদিন ধরেই ট্রিয়াজ সিস্টেম চালু করার কথা বলে আসছি। এই ট্রিয়াজ সিস্টেমটা আসলে কী? এই সিস্টেম অনুযায়ী, সরকারী বড় হাসপাতালগুলোতে একটা কর্ণার থাকবে, যেখানে যে কোন রোগী এসে রিপোর্ট করবে। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার (বিদেশে এই কাজটি একজন নার্স করে থাকেন) প্রাথমিকভাবে রোগীকে দেখে বলবেন, পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তিনি কোন বিভাগে যাবেন। এইসব হাসপাতালে একটা ‘রেড জোন’ থাকবে, যেখানে পরীোক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত কোভিড১৯ রোগী থাকবেন। অথবা ওই হাসপাতালে রেড জোন না থাকলে নিশ্চিত কোভিড১৯ রোগীদের সরকার নির্ধারিত হাসপাতালেও পাঠানো যেতে পারে। এবার যেসব রোগীর টেস্ট করা হয়নি অথচ তাদের কোভিড১৯ এর মত উপসর্গ আছে, যাদের আমাদের কাছে ‘সন্দেহজনক’ বা সাসপেক্ট কোভিড১৯ রোগী বলে মনে হচ্ছে, তাদের জন্য ‘অরেঞ্জ জোনে’ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এই অরেঞ্জ জোনে যেসব রোগী থাকবেন, তাদের কী ধরণের চিকিৎলা দিকে হবে, তা ইতিমধ্যে ডাক্তাররা জানেন। সেই সাথে তার যদি অন্য কোন অসুখ থাকে সেটারও চিকিৎসা করতে হবে। অরেঞ্জ জোনে যেসব রোগী ভর্তি হবেন, তাদের সবাই করোনা১৯ ভাইরাস পজিটিভ হবেন না, অনেকেই নেগেটিভও হবেন। তবে তাদের সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব করোনার টেস্ট করাতে হবে। যে সব ডাক্তার  ও স্বাস্থ্যকর্মীরী ট্রিয়াজ, রেড এবং অরেঞ্জ জোনের ওয়ার্ডে কাজ করবেন, তাদের জন্য ফুল সেট পিপিই দরকার হবে। হাসপাতালের অন্য বিভাগে কর্মরত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হয়তো অ্যাপ্রন বা গাউন, মাস্ক এবং গ্লাভস পরিহিত থাকলেই চলবে, ফুল সেট পিপিইর দরকার নাই। উন্নত দেশগুলোর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ট্রিয়াজ সিস্টেম অনেক আগে থেকেই চালু আছে। এর ফলে একদিকে রোগীরা যেমন উপকৃত হয়, তেমনি ডাক্তারদের চিকিৎসা করতেও সুবিধা হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে জ্বরের রোগীদের জন্য আলাদা ভাবে ফিভার ক্লিনিক চালু করা হয়েছে, সেখানে রোগীদের করোনা টেস্টেরও সুযোগ আছে। এটা একটা চমৎকার উদ্যোগ, কর্তৃপক্ষ এর জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। 

এই যে সরকারী বড় হাসপাতালগুলোতে ট্রিয়াজ সিস্টেম চালু করা, রেড জোন ও অরেঞ্জ জোন চালু করা এগুলো কাদের দায়িত্ব? এটি কি ডাক্তাররা চাইলে হাসপাতালে শুরু করতে পারেন? না, এটা হলো স্বাস্থ্যখাত বা হেলথ সিস্টেমের দায়িত্ব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আগেই ট্রিয়াজ সিস্টেম চালু করে সন্দেহজনক কোভিড১৯ কেসের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। দু:খজনক বাস্তবতা হলো, তারা এটা সময়মত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন শুনছি, তারা এরকম কিছু করার চেষ্টা করছে। যদি করেও, তবে নিশ্চিত করতে হবে যেন ট্রিয়াজ সিস্টেম, রেড ও অরেঞ্জ জোন ব্যাপারটা কার্যকর হয়। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সারা দেশে একাধিক ফিল্ড হাসপাতাল চালু করে জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্টের রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্যখাতের ব্যর্থতার দায় কৌশলে ডাক্তারদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত করা যাবে না। এটি মেনে নেওয়া যায় না। কোন ঘটনা ঘটার পরে প্রতিক্রিয়া (reactive) নয়, স্বাস্থ্যখাতকে আগে থেকেই পরিকল্পনা করে (proactive) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এভাবে আর কতকাল ব্যর্থতার দায় বয়ে বেড়াবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত আর অন্যায্যভাবে দোষ গিয়ে চাপবে ডাক্তারদের উপর?

-চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস এন্ড রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭