ইনসাইড আর্টিকেল

৮৫তম পর্ব: একটু ঘুম আসে, আবার ভেঙে যায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 04/04/2020


Thumbnail

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ এর ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে সরকার। এই মহামানবের বেড়ে ওঠা, রাজনীতি এবং বাঙালির জাতির পিতা হয়ে ওঠার যে গল্প তা তিনি নিজেই তার বিভিন্ন বক্তব্য, বিবৃতি, স্মৃতিচারনা এবং ডায়রিতে লিখে গেছেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করে মুজিববর্ষে বাংলা ইনসাইডারের এই বিনম্র নিবেদন:

৮ ই জুন ১৯৬৬, বুধবার

ছয়দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণি যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশিদিন করতে পারবেনা, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিৎ।

যে রক্ত আজ আমার ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কাল রাস্তা লাল করল,সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এদেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল , আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি দিতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।

 

সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে বাইরে করতে লাগলাম। যদি কেহ বন্দি পশুপক্ষী দেখে থাকেন তারা অনুভব করতে পারবেন। শত শত লোককে গ্রেপ্তার করে আনছে। তাদের দূরাবস্থা চিন্তা করতে ভয় হয়। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে। খালি গা- কাপড় নাই, একদিন একরাত পর্যন্ত থানায় বা অন্য কোথাও আটকাইয়া রেখেছিল। খাবারও দেয় নাই, গোসল নাই। সাজা দিয়ে নিয়ে এসেছে। এদের কিছু লোককে কয়েদির কাপড় পরাইয়া দিয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম তার পার্শেই পুরানা বিশ সেলে রাতে ৮২ জন ছেলেকে নিয়ে এসেছে, বয়স ১৫ বৎসরের বেশি হবে না কারও। অনেকের মাথায় আঘাত। অনেকের পায়ে আঘাত, অনেকে হাঁটতে পারে না। হাকিম বাহাদুর বোধ হয় কারও কথা শোনেন নাই, জেল দিয়ে চলেছেন। রাতে জানালা দিয়ে দেখলাম, এই ছেলেগুলিকে নিয়ে এসেছে। দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘জমাদার সাহেব এদের খাবার বন্দোবস্ত করে দিবেন। বোধ হয় দুইদিন না খাওয়া।’ মানুষ যখন অমানুষ হয় তখন হিংস্র জন্তুর চেয়েও হিংস্র হয়ে থাকে। রাত্রে আমি ঘুমাতে পারলাম না। দুই একজন জমাদার ও সিপাই এদের উপর অত্যাচার করছে। আর সবাই এদের আরাম দেবার চেষ্টা করছে। কয়েদিরা ছোট ছোট ছেলেদের খুব আদর করে থাকে। নিজে না খেয়েও অনেককে খাওয়াইয়া থাকে। অনেকে নিজের গামছা দিয়েছে। যারা এদের উপর অত্যাচার করেছে তাদের কথা আমার মনে হইল। নাম আমি লেখব না। রাত কেটে গেল। একটু ঘুম আসে, আবার ঘুম ভেঙে যায়।

(কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর লিখিত ডায়েরি; ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে…)

চলবে...

 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭