লিট ইনসাইড

করোনা চিকিৎসায় রবীন্দ্রনাথ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/04/2020


Thumbnail

তখনকার ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘যুদ্ধজ্বর’ নামে পরিচিত হয়েছিল। বহু জায়গায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল।শান্তিনিকেতনও রেহাই পায়নি।

রবীন্দ্রনাথ রাণুকে চিঠি লিখলেন, ‘আমাদের ইস্কুলেও সেই জ্বর এসে পড়েছে। কিন্তু অন্য জায়গার মতো তেমন প্রবল নয়। অনেক ছেলেই এখন হাঁসপাতালে গেছে। কিন্তু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সীতা দেবীর ‘পুণ‍্য স্মৃতি’ থেকে জানা যায়, দেশে জ্বরের মহামারির ছোঁয়া আশ্রমের বহু ছাত্রছাত্রীর উপর এসে পড়ে। তারা অসুস্থ হয়ে যায়। সীতা দেবীর লেখা থেকেই জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ নিজে রোজ ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক অসুস্থ ছাত্রছাত্রীকে দেখতে যেতেন। তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতেন। এমনকি চিকিৎসাও করতেন। সীতা দেবী লিখছেন, ‘সে বার তিনি একটি ভেষজ প্রতিষেধক তৈরি করলেন। সেই প্রতিষেধকটির নাম ‘পঞ্চতিক্ত পাঁচন’।’

কী এই পঞ্চতিক্ত পাঁচন? তেউরি, নিম, গুলঞ্চ, নিশিন্দা এবং থানকুনি বেটে একসঙ্গে সবটা মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পাঁচন। রবীন্দ্রনাথ এই পাঁচন তৈরি করে প্রত্যেক আশ্রমবাসীকে নিয়ম করে খাওয়াতেন এবং সে সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারি আটকেছিলেন। সীতা দেবী ছাড়াও অজিতকুমার চক্রবর্তীর মরণাপন্ন পীড়ার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ চিকিৎসক দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে ১৯১৮-র ২৯ ডিসেম্বর চিঠিতে লিখছেন, ‘ছাত্র সৌভাগ্যক্রমে সকলেই ভাল আছে— তাদের সকলকেই রোজ পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাওয়াই— আমার বিশ্বাস সেই জন্য তাদের মধ্যে একটি case-ও হয়নি, অথচ তারা অধিকাংশই সংক্রামকের কেন্দ্র থেকে এবং রোগগ্রস্ত পরিবার থেকে  এসেচে।’

কিশোরবেলা থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর অনুসন্ধিৎসা। যৌবনে শান্তিনিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর কালীমোহন ঘোষকে আশ্রমে আসার আমন্ত্রণ জানান কবি। চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার এখানে চিকিৎসক বলিতে আমি ও ক্ষিতিমোহনবাবু’ একান্ত বাধ্য হয়ে বাড়তে থাকা আশ্রমবাসীদের চিকিৎসার ভার নিজের হাতে নেন রবীন্দ্রনাথ। কবিকে এ কাজে সাহায্য করতেন অমর্ত্য সেনের দাদা, আয়ুর্বেদজ্ঞ ক্ষিতিমোহন সেন। আশ্রম দিনে দিনে বড় হচ্ছে, বাড়ছে আশ্রমিকদের ব্যধি। অগত্যা রোগীদের চিকিৎসার প্রাথমিক দায়িত্ব হাতে তুলে নিতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে।

ভারতীয় চিকিৎসকরা জানান, রবীন্দ্রনাথ যে গুলঞ্চ ব্যবহার করেছিলেন তা শুধু করোনা নয়, যে কোনও রোগ প্রতিরোধে খুব উপকারী। এই পাঁচন দেহে অ্যান্টি ভাইরাল জোন তৈরি করে যা করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে অত্যন্ত জরুরি। তবে এই পাঁচন খেলেই যে করোনা সেরে যাবে এটা বলা যাচ্ছে  না।’’

১৯১৯-এর ১ জানুয়ারি বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে সে সময়ের ইনফ্লুয়েঞ্জার কথা উল্লেখ করে চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখছেন, ‘আমার এখানে প্রায় দুশো লোক, অথচ হাঁসপাতাল প্রায়ই শূন্য পড়ে আছে— এমন কখনও হয় না— তাই মনে ভাবচি এটা নিশ্চয়ই পাঁচনের গুণে হয়েচে।’ ছাত্রদের নিয়ে খানিক নিশ্চিত হলেও তিনি পরিবারের মানুষদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। চিঠিতে যেমন লিখছেন,‘বউমার খুব কঠিন রকম ন্যুমোনিয়া হয়েছিল। অনেক দিন লড়াই করে কাল থেকে ভাল বোধ হচ্ছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বোধ হয় অনেক দিন লাগবে। হেমলতা এবং সুকেশী এখনো ভুগচেন। তার মধ্যে হেমলতা প্রায় সেরে উঠেচেন— কিন্তু সুকেশীর জন্য ভাবনার কারণ আছে। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাইয়ে আসচি।"

রবীন্দ্রনাথের যে পঞ্চতিক্ত পাঁচন তার অনেক গুণ আছে। নিম যেমন অ্যান্টি ইনফেক্টিভ। নিম খাই, লাগাই। এগুলো সরাসরি অ্যান্টি ভাইরাল না হলেও ভাইরাস যে পরিবেশ পছন্দ করে সেগুলো নষ্ট করে দেওয়ার জন্য এগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।

রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত নিমপাতার রস খেতেন। ঠাকুরবাড়িতেও ত্বক থেকে শরীরের যত্নে নানা পথ্য ব্যবহার করা হত।

রবীন্দ্রনাথের এই পাঁচন যে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাসের সঙ্গে লড়েছিল তার প্রমাণ দিতে তিনি চিঠিতে লিখছেন, ‘‘ছেলেদের অনেকেই ছুটীর মধ্যে বাড়ীতে নিজেরা ভুগেছে এবং সংক্রামকের আড্ডা থেকে এবং কেউ কেউ মৃত্যুশয্যা থেকে এসেচে। ভয় ছিল, তারা এখানে এসে রোগ ছড়াবে— কিন্তু একটুও সে লক্ষণ ঘটেনি, এবং সাধারণ জ্বরও এ বছর অনেক কম।" ছাত্ররা কোনওভাবে ফাঁকি না  দেয় সে দিকে কড়া নজর ছিল রবীন্দ্রনাথের।

নিজের ডাক্তারি নিয়ে নিজেই মজা করতেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী রানিকে এক চিঠিতে লিখছেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় কোনও ভালো কবিরাজি টনিক ব্যবহার করলে তোমার ঘুসঘুসে জ্বরের ক্ষেত্রে কিরকম হয়। কবিরাজ বলতে আমাকে বুঝে নিও না, তাতে আমাকে খাটো করা হবে … আমি কবি-রাজ নই, কবিসম্রাট।’



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭