ইনসাইড আর্টিকেল

আমাদের শহর কি একটি সুখী শহর?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/07/2017


Thumbnail


সাম্প্রতিক সুইডেনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫ মিনিটের পারস্পরিক বাগবিতণ্ডায়, সমপরিমাণ ভ্রমণের চেয়ে প্রায় চল্লিশ শতাংশ বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের আশঙ্কা রয়েছে - যেখানে হাঁটা, বাইকিং, সাইক্লিং কিংবা সামাজিক কথোপকথনে যার অনুপাত অনেকাংশে কম - নেই বললেই চলে।

বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের অধিকাংশ শহরই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্মুখীন। এক্ষেত্রে শহরগুলোতে অর্থ কীভাবে ব্যাবহৃত হচ্ছে এটিই প্রধান মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। আর এর সঙ্গে উঠে আসছে আরেকটি পরিসংখ্যান। সার্ভে এবং জনসংখ্যা পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে শহরকেন্দ্রিক মানুষেরা জীবন যাত্রার মানের দিক থেকে ভালো বোধ করছে না, আর এর মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে জ্যামিতিক হারে। প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, বড় বড় শহরে বসবাসকারীরা সাধারণত অন্যত্র শহর থেকে দূরে বসবাসকারী লোকদের তুলনায় কম সুখী হয় এবং সেক্ষেত্রে তাদের উচ্চ আয় সুখী জীবন যাপনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।

‘আরবান হাব’ এর গবেষণায় দেখা যায় - প্রশ্ন করা হয়েছিল শহরে বসবাসরত সাধারণ এবং উচ্চ বিত্তবান অনেককেই। আপনার শহর কি একটি সুখী শহর? আপনি নিজে কি আপনার শহরকে সুখী করে রাখার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন? এবং এই লেখাটি লেখার জন্য এই বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখা গেছে ইতিমধ্যে অনেক গবেষণাই হয়েছে এসবের ওপর। জরিপও হয়েছে অনেক। জরিপগুলোর সঙ্গে কীভাবে শহরকে সুখী ও সুন্দর করা যায় তার অনেক সমাধানের পথও দেখানো আছে। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে এবং জানতে শিখেছে টাকা উপার্জন - খরচ, আধিপত্ব, ক্ষমতা প্রদর্শন করাই সব কিছু নয় বরং এতে হিতে বিপরীত হয়েছে প্রায় সবক্ষেত্রেই, যার অনেক উদাহরণ বর্তমানে আমাদের দেশেই চলমান।

এ প্রসঙ্গে কলম্বিয়ার বোগোটার মেয়র এনরিক পেনিলোস লন্ডনো প্রাসঙ্গিক একটি কথা বলেছেন। তার মতে, আমাদের বর্তমান শহরকেন্দ্রিক সুখের মানদণ্ডের পরীক্ষা শুধুমাত্র অর্থনীতি ঠিক করতে পারে না। কিন্তু আমরা মানুষকে সমৃদ্ধ করার জন্য শহরের টেকসই নকশা প্রণয়ন করতে পারি, এবং সেই শহর অনেকাংশেই তাদেরকে সুখী করতে পারে।

এবার কেন কথাটিকে প্রাসঙ্গিক বলা হলো, সেই প্রসঙ্গেই আসা যাক। কলম্বিয়ার বোগোটা শহরে এবং আশপাশের স্থানগুলোতে দিনকে দিন মাদকদ্রব্য, অপরাধ, প্রতারনাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অবক্ষয় এবং সেই সঙ্গে সামাজিক অপরাধ বেড়েই চলছিল। অনেকেই এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যান চলাচলহীন রাস্তাঘাট, জনসাধারনকে রাস্তা থেকে দূরে রাখা, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন স্থানগুলো পরিকল্পনার অভাবে পড়ে থাকা, সামাজিক স্থানের স্বল্পতা ইত্যাদিকে। সেক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপেই মেয়র শহুরে গাড়ির বৃদ্ধির মধ্যে আরও অর্থ বিনিয়োগ না করে শহরকেন্দ্রিক মানব উন্নয়নের একটি স্কেল অবকাঠামো পুনর্নিমাণের উচ্চভিলাষী পরিকল্পনা শুরু করেন। সাইকেলের নতুন পথ, পায়ে হাটার রাস্তা, নতুন সবুজ উদ্যান, দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম, উন্নত নেটওয়ার্ক সিস্টেমের প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শহরের নকশা প্রণয়নে হাত দেন, যার সুফল পেতে শুরু করেন অচিরেই। ধীরে ধীরে সেটি হয়ে ওঠে টেকসই উন্নয়নের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

পৃথিবীর উন্নত প্রায় সব দেশেই শহরের উন্নতি এবং সুখের মানদণ্ডের একটি সূচক আছে, যা তারা সব সময় মেনে চলে বা চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার শহর সিওল এর বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন তারা তাদের নিজ শহরের প্রতি নিজেরা অধিক যত্নবান, যে কারণে তারা নিজেদের সুখী মনে করেন।

ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইউরোব্যাটারোমি জরিপে নরওয়ের অসলো এবং সুইজারল্যান্ডের জুরিখ সবচেয়ে এগিয়ে। অন্যদিকে যুক্তরাস্ট্রের ফ্লোরিডা, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, সুইডেন ইত্যাদি দেশেই সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল নিজস্ব কিছু সূচক আছে, যা সাধারণত নাগরিকেরা নিজ স্বাথের্ই সবসময় মেনে চলে, কারণ তারা তাদের নিজেদের ভালো-মন্দ সঠিকভাবে উপলবিদ্ধকরতে সক্ষম, যে সক্ষমতা বর্তমানে আমরা হারিয়ে ফেলে একে অন্যের দিকে দোষ ঠুকে দেই শুধুমাত্র। অন্যান্য কিছু শহরে উন্নত জীবনের লক্ষ্যে শহুরে সুখের জরিপ পরিচালনা করছে, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য ২০১৩ সালে সান্তা মনিকা, সিএ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) একটি ‘স্থানীয় ওয়েলিং ইনডেক্স’ তৈরির পরিকল্পনার জন্য প্রধান পুরস্কার জিতেছেন। বর্তমানে মানুষকেন্দ্রিক শহরগুলো সবুজ শহরের নকশার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের শহরকেন্দ্রিক মেয়রগণ বিশেষ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উত্তর - দক্ষিণ মেয়রদ্বয়কে সাধুবাদ জানাতেই হয় - তাদের কিছু কর্মপরিকল্পনার জন্য যার মধ্যে বেদখল জমির ব্যাবস্থাপনা, অনিয়ন্ত্রিত পাকিং উচ্ছেদ, বিশেষ করে বর্তমানের ‘জল সবুজের ঢাকা’ প্রকল্পটি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, যদি খেলার মাঠগুলো পুনরুদ্ধার হয়, তাহলে কিছুটা হলেও সুখের মানদণ্ডে আমরা একটু এগিয়ে যাব বৈকি। আর ‘জল সবুজের ঢাকা’ এর মতো প্রকল্প চট্রগ্রাম সহ দেশের সকল শহরে পরিচালিত হওয়া বিশেষভাবে জরুরি। এছাড়াও কার মুক্ত দিন, কিংবা গাড়ি মুক্ত অঞ্চল, জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য জমি পুণরুদ্ধার শহুরে নাগরিকদের শহরকেন্দ্রিক স্থানগুলোর উপলব্ধি করার প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করে, যার দরুণ প্রতিনিয়ত তারা শহরকে নিজেদের মতো ভালোবাসতে শেখে। সেক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আমরা নিজেদের অজান্তেই প্রায় হারাতে বসেছি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবশ্যই একটি শহরের জন্য উত্তম, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নতুন চাকরি, নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু পরবর্তীতে এটিই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সামাজিক সংযোগ স্থাপন, সহমর্মিতা, নির্মল পরিকাঠামো, আর এর অভাবে সমাজে জন্ম নেবে নীতি বিবর্জিত কিছু উদাহরণ, যে জন্য দায়ী আমরাই আর আমাদের এককেন্দ্রীকতা। আমাদের শহরগুলোর জন্য তৈরি করতে হবে ‘স্থানীয় ওয়েলিং ইনডেক্স’। একটি সুন্দর-পরিচ্ছন্ন শহরের লক্ষে সমন্বয় করতে হবে সামাজিক অবকাঠামোকে ।

সজল চৌধুরী
সহকারী  অধ্যাপক ও স্থাপত্য-পরিবেশ বিষয়ক গবেষক
স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,চট্টগ্রাম।
sajal_c@yahoo.com 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭