ইনসাইড ট্রেড

করোনাকালে প্রকৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/05/2020


Thumbnail

করোনাকালেও রবীন্দ্রনাথকে স্বরণ করতে হবে। প্রকৃতির ওপর অত্যাচার অনাচারের যে তাণ্ডব, তার ফল হলো এই করোনা। করোনা প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। আমরা এই করোনাকালে যতই রবীন্দ্রনাথকে স্বরণ করে তার সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবো ততই প্রকৃতিকে ভালোবাসতে পারবো। প্রকৃতিকে ভালোবেসে করোনাকে দূর করতে পারবো আমরা।   

মানুষ যখন থেকে আধুনিক সভ্যতার সন্ধান পেয়েছে তখন থেকেই এক ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত অরণ্য বিনাশের পথে ছোটাছুটি করছে। জ্বালানির জন্য গাছ কাটছে। কিন্তু এতে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এবং মানবসভ্যতা ধ্বংসের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে করিয়ে দেন ‘একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। এখানকার সভ্যতা নগরের পরিবর্তে অরণ্যে বিকশিত হয়েছে, ভারতের প্রথম আশ্চর্যজনক বিকাশ দেখা গেছে যেখানে, যেখানে মানুষে জীবন ধারণের জন্য আবদ্ধ হয়নি। এসব জায়গায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ছিল।

মানুষের ওপর স্রষ্টার অর্পিত সৃষ্টিসংক্রান্ত দায়িত্ব মানুষের অনুধাবন করা উচিত। যেকোনো ধরনের আক্রমণ সমগ্র পরিমণ্ডলের জন্য দুর্যোগে পরিণত হবে। এটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে মানুষ ও প্রকৃতির ভবিষ্যৎ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।’ (‘তপোবন’, রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৯০)

আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের এসব উৎসাহব্যঞ্জক কথা সংগ্রহ করে মানুষকে উৎসাহিত করি প্রকৃতিকে ভালোবাসার জন্য, তবে ধরনীর মুখে নিশ্চয়ই হাসি ফোটানো যাবে। তাঁর চিন্তার সৌন্দর্য ছিল এটাই যে তিনি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অভ্যন্তরে তাঁর চাওয়াগুলোকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন গভীর এক আবেদনের মাধ্যমে। আর সে কারণেই তিনি আজও রয়েছেন আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পচিন্তা ও চেতনায় প্রকৃতি অন্যতম এক অনুষঙ্গ। নানা কথামালায় তিনি বলেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। সেই কথামালা প্রমাণ করে তিনি কত আগেই না বুঝেছিলেন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা না করা গেলে মাটি ও মানুষের যে চিরন্তন সম্পর্ক সেটা আর টিকবে না। দীর্ঘ জীবনপ্রবাহে আর লেখনীতে তাই প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধ আর দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ ভাবনায় তিনি ছিলেন একজন অগ্রগামী চিন্তার মানুষ। তিনি নিরন্তর প্রকৃতি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে সমন্বয় অন্বেষণ করেছেন। 

দেখা যায়, এক শতাব্দী আগেই পরিবেশদূষণ নিয়ে তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করেছিলেন। যে ভোগান্তিতে আজ আমরা ভুগছি। ১৯১৬ সালে জাপান যাওয়ার সময় সমুদ্রপথে তেল নিঃসরণের বিষয়টি দেখে তিনি প্রথম পরিবেশের ওপর মানুষের প্রভাব নিয়ে চিন্তান্বিত হন। সেটা পশ্চিমা বিশ্বের পরিবেশ আন্দোলন দানা বাঁধার কয়েক দশক আগের কথা। আমরা দেখতে পাই, সর্বদাই তিনি প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন সুনিপুণভাবে।

রবীন্দ্রনাথ কবিতা, নাটক, ছোটগল্প ও গানে আমাদের পৃথিবী ও প্রকৃতির সুরক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রকৃতি পর্যায় নামে বিভিন্ন ভাগে কবিতার মতো করে গীতিকবিতা রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃতভাবেই লেখেননি; তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে তার বাস্তব রূপও দেখিয়েছিলেন। সব দিকে সবুজ বেষ্টনী দ্বারা শান্তিনিকেতন ঘেরা। পৃথিবীজুড়ে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের বিরল উদাহরণ তিনি শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন।

অন্তরে শান্তিনিকেতনের অরণ্যময় সবুজ পরিবেশ ও পূর্ব বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে মাঝেমধ্যে বসবাস নৈসর্গিক পৃথিবীর প্রতি তাঁর প্রেমকে বেগবান করেছিল। তাঁর চারপাশের দর্শন সম্পর্কে জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে শান্তিনিকেতনের স্থাপত্য বিষয়ে তাঁর ভাবনা, শ্রীনিকেতনের অধিবাসীদের কল্যাণে তাঁর চিন্তা, প্রজা-চাষিদের প্রতি তাঁর দরদ, চাষ মৌসুমের শুরুতে অভিষেক অনুষ্ঠান, সমবায় বিষয়ে তাঁর ভাবনা, ‘অরণ্যদেবতা’ প্রবন্ধের রচয়িতা এবং সর্বোপরি গ্রামীণ মেলার অগ্রদূত রবীন্দ্রনাথের কাছে। ১৯২৭ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী এক উৎসবের শুরু করেন। ওই উৎসবে তাঁর লেখা গান ও কবিতা ছাত্র-ছাত্রীরা গাইত এবং আবৃত্তি করতে পারত। এ ধরনের অগ্রসর চিন্তা তাঁর পরিবেশ প্রচারণার ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক ভাবের অবতারণা করেছিল। তাই এটা কোনো নেতিবাচক প্রচারণা ছিল না, যা মানুষের করা উচিত না বরং বৈচিত্র্যময় উদ্ভাবনী প্রকাশের এটা ছিল সুদক্ষ এক নাড়া। এই বিষয়টিই অসংখ্য মানুষকে তাঁর প্রচারণার সঙ্গে সংযুক্ত হতে সাহস জুগিয়েছিল। ‘পরিবেশ রক্ষায় তিনি চেয়েছিলেন অধিকতর সরকারি ও বেসরকারি প্রতিশ্রুতি’ (রবীন্দ্রনাথ ও ভারতবর্ষ, অমর্ত্য সেন, ভারতবিচিত্রা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৯৭)। অমর্ত্য সেনের এই উক্তি থেকেই এটা পরিষ্কার হয় যে বৃক্ষের সুরক্ষায় রবীন্দ্রনাথের বিবেচনার ব্যাপ্তিটা কতটুকু।

হাল কর্ষণের প্রবর্তন করা হয় ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে। এ রকম একটি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে’-যা ছিল আসলে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী বৃদ্ধিতে তাঁর উদাত্ত আহ্বান।

সারা বিশ্বে এই উৎসব এক অনন্য উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃত, যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনাপ্রবণ-ভবঘুরে সময়ে বিশ্বদর্শনের অসংখ্য উদ্ভাস প্রতীয়মান হয়। সম্ভবত সারা বিশ্বে পরিবেশগত গণসচেতনতায় এটাই প্রথম কোনো সচেতন আন্দোলন।

রবীন্দ্রনাথের বিশুদ্ধ পানি ও গণস্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনা তাঁর পরিবেশের প্রতি ভাবনাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর দাবিগুলোর মধ্য দিয়ে গ্রামের চাহিদাগুলো বাস্তবায়িত করতে, যা কিনা শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অনুকরণীয় কাজের মাধ্যমে হবে। শান্তিনিকেতনে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসগুলো হতো গাছের ছায়ায়, যা ভাবতে আবেগতাড়িত মনে হলেও আসলে ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগটা আরো বাড়ানোর জন্য এটাই সবচেয়ে সুচিন্তিত কাজ, যা তাদের অবচেতনভাবেই পরিবেশকে ভালোবাসতে শেখায়। তিনি শুকনো মৌসুমের শেষে বর্ষার আগমনকেও একটা উদ্যাপনের উপলক্ষ হিসেবে চালু করেন (‘বর্ষামঙ্গল’)।

মানুষের সর্বগ্রাসী লাভ ও লোভের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি শব্দমালা সাজিয়েছেন। ‘বনজ সম্পদকে মানুষের অতিরিক্ত লোভের কবল থেকে বাঁচানো একটি বৈশ্বিক সমস্যা।’ স্রষ্টা জীবন দিয়েছেন, জীবনকে সাজানোর উপাদানও চারদিকে দিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু লোভী মানুষ মৃত্যুর কৌশলই সরবরাহ করেছে শুধু। মানবসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্রষ্টার পরিকল্পনা অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য, বন ধ্বংস করে লোভী মানুষজন নিজেদের বিনাশই ডেকে এনেছে। জমিকে উর্বর করে, বায়ুকে বিশুদ্ধ করে এমন সব গাছপালা, শাকসবজি নির্মূল করতে শুরু করেছে।...অনুভূতিহীন লোকজন প্রকৃতির উপহারসমূহ—তাদের কল্যাণ ধ্বংস করছে।’ (রবীন্দ্ররচনাবলী ১৪, পৃষ্ঠা-৩৭৩)

শতবর্ষেরও আগে আমাদেরই প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে তাঁর সুগভীর চিন্তা ও উদ্যোগের নানা চিহ্ন রেখে গেছেন বাংলা সাহিত্যে ও কর্মে। আজ আমরা তাঁকে স্মরণের সময় গভীর বিস্ময়ে লক্ষ করি কতটা দূরদর্শী তিনি ছিলেন।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭