ইনসাইড থট

সৃজনশীল শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/07/2017


Thumbnail


আমাদের শিক্ষা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলেই আলোচনা করতে হয় তপোবনের শিক্ষার কথা। বর্তমানে আমাদের  বিদ্যালয়গুলোর ক্লাস শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে, কিন্তু একদিন আমাদের গুরু মহাশয়ের আশ্রমে পাঠ শুরুর আগে গুরু শিষ্য সমবেত কণ্ঠে উচ্চারণ করতেন বৃহদারণ্যক উপনিষদের সেই অবিনাশী উজ্জ্বল উচ্চারণ-

অসৎ হতে আমাকে সৎপথে নিয়ে যাও
অন্ধকার থেকে আমাকে আলোকে নিয়ে যাও
মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতলোকে নিয়ে যাও।

ক্লাসে গুরু মহাশয় প্রতিদিন বলতেন, মানুষ অমৃত্যস্যঃ পুত্রঃ, আত্ননং বৃদ্ধি, ভূমাকে জানো। প্রতিদিনের তুচ্ছতা , গ্লানি, ও হীনমন্যতা এবং ক্ষুদ্রত্ব, সংকীর্ণতা , অসত্য ও মিথ্যাকে পরিহার করে সত্যানুসন্ধানী হও, সূর্যসনাথ হও। আকাশ থেকে গ্রহ , নক্ষত্র ও প্রকৃতি থেকে নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর ও বৃক্ষ থেকে শিক্ষা লাভ কর।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব কারণ সে সৃজনশীল। বাবুই পাখি আর মাকড়া শুধু বাসা ও জাল বুনতেই জানে কিন্তু মানুষ প্রতি পদে পদে নতুনকে সৃষ্টি করে চলে কারণ মানুষ সৃজনশীল।মানুষের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা পথ নির্মাতা ও পথ প্রদর্শক। মানুষ অশ্রান্ত যাত্রা করেছে শুধু অন্ন বস্ত্রের জন্য নয়- আপনার সমস্ত শক্তি সাধনা ও সৃজনশীলতা দিয়ে মানবলোকে মহামানবের প্রতিষ্ঠার জন্য।

আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের একটি সৃজনশীল শিক্ষানীতি হবে এবং আমাদের সন্তানেরাও সৃজনশীল হবে এবং তারা দেশ মাটি ও মানুষের একাত্মতায় সম্পৃক্ত হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা যেন একটি টবের পরগাছা হয়ে উঠছে। দেশের মাটির গভীরে তারা শিকর প্রোথিত করতে পারছে না। যাদের সামনে কোনো জানা পথ নেই; আশা , উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নেই। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, লক্ষ্যহীন শিক্ষা মানুষকেও লক্ষ্যহীন করে তোলে।

অধিতবিদ্যাকে সে আত্মস্থ করতে পারেনা। শিক্ষা ব্যবস্থার পরান্নভোজী ছাত্রদের সামনে থাকে তৈরি করা নোট, গাইড ও কোচিং সেন্টার। তাঁকে কোনো চর্চা করতে হয় না এবং পরীক্ষার পড়া তৈরি করার জন্য তাকে কোনো চেষ্টা করতে হয় না। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি নেই বলেই শিক্ষার্থীরা অধিত বিদ্যাকে আত্মস্থ করতে পারেনা। এই মুখস্থ বিদ্যাকে রবীন্দ্রনাথ চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন, ‘মুখস্থ করিয়া পাশ করাইতো চৌর্যবৃত্তি। পরীক্ষাশালায় যে গোপনে বই লইয়া যায় তার চেয়েও মগজের ভেতর যে মুখস্থ বিদ্যা লুকিয়ে রাখে সে বেশি অপরাধী।’

একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে , তৈরি করা নোট, গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের সাহায্যে ফটোকপি এবং ব্যবসায়িক ও যান্ত্রিক শিক্ষার বৃত্তে বন্দী শিক্ষার্থীরা দিন দিন বাংলা ভাষার ওপর দখল হারিয়ে ফেলছে। তাদের বক্তব্য, চিন্তাকে তারা লেখ্য ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র শিক্ষকদের যে আত্মিক সম্পর্ক ও ভাবের আদান প্রদান তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অর্থের বিনিময়ে অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে। নোট দেওয়ার ফলে যে বাণিজ্যিক প্রথা গড়ে ওঠে এর মধ্য দিয়ে আত্মিক সম্বন্ধ না থাকারই কথা।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়নি। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তবে এর দায়-দায়িত্ব অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এমন এক ধরনের সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে যেন তারা প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার ও গাইড বই নির্ভর না হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থী অধিত বিষয়কে আত্মস্থ করবে, চর্চা করবে এবং বিশ্লেষণ করবে। তারা প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে, অনুসন্ধিৎসু হবে, গবেষণা  করবে এবং আবিষ্কারক হবে। ভাষার ওপর এবং তা প্রকাশের ওপর তাদের দখল থাকবে।

সৃজনশীল শিক্ষা ও শিক্ষকতা যে একটি নবযুগ ও নবজাগরণ সৃষ্টি করতে পারে এর প্রমাণ হিন্দু কলেজ, ডিরোজিও এবং ইয়াংবেঙ্গল গোষ্ঠী। তারা বঙ্গীয় রেনেসাঁ ও নব্য বাংলার অগ্রদূত স্রষ্টা। একমাত্র সৃজনশীল শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।

ছাত্রছাত্রীরা কেবল সৃজনশীল হবে শুধু এমন নয়। শিক্ষকদেরও সৃজনশীল হতে হবে। কারণ মহৎ শিক্ষক ছাড়া একটি জাতি বড় হতে পারেনা। জরাজীর্ণ এই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির বিকাশ ছাড়া এদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প পথ নেই। আমাদের রয়েছে ভাষা আন্দোলন, ও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব যা আমাদের সৃজনশীল জাতি গঠনের প্রেরণা।

ড. সফিউদ্দিন আহমেদ
সাবেক অধ্যাপক
শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী




প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭