ইনসাইড থট

দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে কি?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 23/05/2020


Thumbnail

করোনাভাইরাসের তিক্ত অভিজ্ঞতায় পণ্য সরবরাহ চেইন বহুমুখী করার লক্ষ্যে বিশ্বের উন্নত দেশ তাদের বড় বড় কোম্পানির বিনিয়োগ চীন থেকে সরিয়ে আশেপাশের অন্য দেশে নিয়ে চায়। এমতাবস্থায় ইন্দোনেশিয়া, ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং ভিয়েতনামে কারখানা করতে চাইছে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে? বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেবে না কেন তারা? কোনো কারণে বাংলাদেশ কি সুযোগ হারাচ্ছে? যদি হয়, তাহলে করণীয় কি?

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ঈদের আগে শেষ কার্যদিবস গত বুধবার বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির বৈঠক করেন সচিবালয়ে। বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রী, উপেদষ্টা, সচিব, ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষগুলোর প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। এতে কেউ সরাসরি অংশ নেন, কেউবা অংশ নেন ভার্চুয়ালি। বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দীন পুরো বৈঠক সঞ্চালনা করেন।   

বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, বিশেষ করে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) নিয়ে বিদেশী আর সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে তিন দশকের মত কাজ করেছেন এমন একজন উপরের খবর দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেন যে, সর্ষের ভিতরেই ভুত। তাই সেই ভুত না তাড়ালে বাংলাদেশে এফডিআই আনা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। বিদেশীরা কেন আসতে চান না, কি তাদের চাহিদা, আর বাংলাদেশ কি এফডিআই আনতে চায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কয়েকটি প্রশ্নের সমাধান আগে করতে হবে। বিডা (বিওআই)’র যে আইন আছে তা খুব ভালো আইন এফডিআই এর আকর্ষণের জন্য। কিন্তু বিডাতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস থাকলেও তা অনেকটাই কাগজে কলমে, বাস্তবে না। এখানে বিদেশী কোম্পানির রেজিস্ট্রেশনে অযথা হয়রানী করা হয়। এডমিন ক্যাডারের অফিসার-গন ২/৩ বছরের জন্য বিডাতে পদায়ন হন। তাই তাঁরা সংগঠনের স্পিরিট, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য জানেন না, বা হৃদয়ে ধারণ করেন না। ফলে এফডিআই আকর্ষণের বদলে তাদের পদে পদে বিনিয়োগে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। 

কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য জ্বালানী হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নাকানী চুবানী খাওয়ানো হয়। অনেক সময় গ্যাসের কানেকশনের আদেশ হবার পরেও তার সংযোগ পেতে লাগে কয়েক বছর। আপদকালীন জ্বালানীর জন্য জেনারেটর এনে পরতে ফেলে রেখে ড্যামারেজ গুনতে হয় বিদেশী কোম্পানিকে, তাও মুক্তি মেলে না।  

প্রায় ৩০ ক্যাটাগরির ভিসা আছে বাংলাদেশে আসার জন্য। একটার সাথে আরেকটির পার্থক্য খুব সামান্য। তাই ব্যাখ্যার ভিন্নতার জন্য ভিসা পাওয়ায় জটিলতা, ভিসা এক্সটেনশনে জটিলতা, ইমিগ্রেশনের সাথে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের সার্ভারের সংযোগহীনতা, এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে সময়ক্ষেপণ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মনে নেতিবাচক ধারণা দেয়।   

বিদেশীদের সবার জন্য ওয়ার্ক পারমিট প্রযোজ্য নয়। কারো কারো জন্য লাগে নো অবজেকশন লেটার। অনেক দপ্তর এমনকি বিডাও এটা গুলিয়ে ফেলে ভিসা পেতে চরম জটিলতার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় পুলিশী ঝামেলা।  বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ কাজ করতে অনুমতি দেওয়ায় যারা জড়িত তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এর প্রধান কারণ। এই কাজে জড়িত অধিকাংশ অফিসারের সুষ্ঠু জ্ঞানের অভাব, অথবা না জানার ভান করায় এই জটিলতা তৈরি হয়।

কোন কোন দেশের সাথে দ্বৈত কর অব্যাহতির চুক্তি আছে তা সংশ্লিষ্টদের না জানার সমস্যা ফলে বিদেশীদের প্রযোজ্য নয় এমন কোম্পানিকেও আয়কর দিতে চাপ দেওয়া হয়। যন্ত্রপাতি আনার ক্ষেত্রে এনবিআর আর পোর্ট অথরিটির অফিসার-গন এইচএসকোডের মার প্যাচের ঝামেলায় পোর্টে আমদানি করা ক্যাপিটাল মেশিনারির জন্য ড্যামারেজ গুনতে হয় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কন্ট্রোলার অফ এক্সপোর্ট এন্ড ইমপোর্টেড আছে আইনি প্যাঁচ আমদানি রপ্তানিতে, যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ভোগায়। ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স, এক্সিডেন্ট পলিসি, রি- ইনস্যুরেন্স পলিসির অস্পষ্টতা, স্বাস্থ্য বীমার ক্ষেত্রেও সব হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায় না, গেলেও থাকে অনেক ঝামেলা।      

আমাদের সরকারী দপ্তরের কর্তারা ভুলে যান যে, একজন বিদেশী বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে সেই দেশের একজন বিনিয়োগ রাষ্ট্রদূত। নতুন বিনিয়োগকারী আসার আগে তাঁর কাছে খোঁজ খবর নিয়ে সেই দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে আসেন।    

একটা দীর্ঘ পরিকল্পনা হাতে নিয়েই বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এফডিআই করতে আসে। এখানে সময় (মানে টাকা) নষ্ট করা বা সময় ক্ষেপণ করা মানে বিনিয়োগকারীর প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়, যার তাঁর উৎপাদিত পণ্যের উপর পড়ে। এর পরে যদি অবৈধ টাকা দিতে হয় বিদেশী বিনিয়োগকারীগন সেটাও হিসাব করে রাখেন। সব মিলিয়ে তাঁরা প্রডাকশন কষ্ট হিসেব করে দেখেন যে, এদেশে বিনিয়োগ ব্যয়বহুল। তাই তাঁরা এদেশে আসতে চান না।   

করোনা পরবর্তীতে ইন্টারনেট অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্রড ব্যান্ড কানেকশনের গ্লোবাল এভারেজ স্পীড হচ্ছে ৫৪.৩৩ এমবিপিএস, সেখানে বাংলাদেশে থাকে ২৫.০৮ এমবিপিএস। তাঁরা জরুরী ডকুমেন্ট পাঠাতে খুব ঝামেলায় পড়েন।     

আমাদের মত দশে একমাত্র কম মূল্যে শ্রমিক পাওয়া যায় বটে কিন্তু অন্য সব কিছুর দাম অনেক বেশি। বাঙ্গালী আবেগী জাতি এরা যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেয়।   

আমাদের দেশে থাকা বিদেশীরা তাদের দেশের বিশেষ খাবার, পানীয়, ইত্যাদি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা পড়েন। ভালো স্কুল না থাকাতে বাচ্চাদের এডুকেশন সুবিধা, নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরা খুব চিন্তা করেন। বিনোদনের সুবিধার অভাব, যেমন বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনোদন ক্লাব, ইত্যাদি না থাকায় মাঝে মাঝেই তাদের বিদেশে যেতে হয়। এ সব তাঁরা হিসেব করেন ব্যবসার খরচ হিসেবে, কারণ তাঁর ব্যবসায়ী।     

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশের সরকারী কর্মচারী কর্মকর্তাদের প্রভু-সুলভ মানসিকতা ও আচরণ, বিনিয়োগকারীদের সম্মান না দেখানো। পরোক্ষভাবে ঘুষের জন্য চাপ দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের ব্যাপারে বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে। বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনগুলো যে কথা বলেন, বাংলাদেশে এসে সেই কথার সাথে বাস্তবের কোন মিল থাকে না।    

মাত্র ৫০ বছর আগে মালয়েশিয়ার অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ ছিল। মালয়েশিয়ার উন্নয়নের রূপকার মাহাথির কিন্তু সেই দেশে এফডিআই আনার অন্যতম জাদুকর হচ্ছেন দাতো জেগাদীসান (Dato Jagadeesan)। মাহাথির তখন মালয়েশিয়ার উঠতি রাজনীতিবিদ। তিনি তাঁর তরুণ বন্ধু দাতো জেগাদীসানকে মালয়েশিয়ান বিওআই’এর দায়িত্ব নিতে বলেন। জেগাদীসান দায়িত্ব নিলেও কিছু শর্ত দেন। সরকার এফডিআই আনার ক্ষেত্রে সেসব শর্ত মেনে নেন।  

দায়িত্ব নেবার পরেই জেগাদীসান তৎকালীন মালয়েশিয়ান বিওআই’এর সবাইকে নিয়ে সভা করেন। এবং দেশের আইন মেনে কত তাড়াতাড়ি  বিদেশী বা দেশী কোম্পানিকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া যায় আর তাদের ক্লেইম সেটেল্ড করা যায় তার ব্যাপারে সবার সাথে আলোচনা করেন। তাঁদের মাইন্ড-সেট চেঞ্জ করেন। সরকারী কর্মচারী কর্মকর্তাদের প্রভু-সুলভ মানসিকতার পরিবর্তন করে সেবক হওয়ার জন্য মোটিভেট করেন। বিনিয়োগকারীদের সম্মান দেখান এই কারণে যে, তাঁরা এক বছরেই হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে, সরকার এত তাড়াতাড়ি পারে না। বিনিয়োগকারীরা বড় অংকের কর দেয়, করের টাকায় হয় দেশের উন্নয়ন। দাতো জেগাদীসান কোন কায়দায় মালয়েশিয়ায় এফডিআই এনেছিলেন বিনিয়োগকারীদের অতুলনীয় সম্মান দেখিয়ে, সে কথা আরেক দিন হবে। খুব ভালো ভালো আইন থাকলেও তাঁর বাস্তবায়নে সরকারী কর্মচারী কর্মকর্তাদের প্রভু-সুলভ মানসিকতার পরিবর্তন না হলে কি বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে?    



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭