ইনসাইড গ্রাউন্ড

এবারের ঈদে হচ্ছেনা ঐতিহ্যবাহী যেসব লোকজ খেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/05/2020


Thumbnail

খেলাধুলায় বাঙালির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। একটা সময় আমাদের গ্রামীণ জীবন কেটেছে এমন সব রকমারি খেলায় যার বিস্তারিত তালিকা করতে গেলে হয়তো ফুরিয়ে যাবে অনেকগুলো পাতা। বর্তমানের ব্যতিব্যস্ত নাগরিক জীবনে আমরা ছুটে চলি আমাদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে। খেলাধুলার জন্য সময় সুযোগ কোনোটাই মেলে না তেমন।

বাঙালির জীবনে খেলাধুলার যে বিশাল সমারোহ ছিলো, নাগরিক জীবনের ভারে হয়তো হারাতে বসেছে অনেক কিছুই। আবার কতগুলো হয়তো কালের বাধা অতিক্রম করে এখনও প্রবল আনন্দ ভাগ করে নেয় আমাদের সাথে। তবে কালের বিবর্তনে এখনো কিছু খেলা বাঙালির জীবনে স্থান করে আছে বিশেষ বিশেষ দিবস নির্ভর হয়ে। প্রাচীন সময় থেকেই এই উৎসবের একটি হচ্ছে ঈদ। শহুরে জীবনে ঈদ মানে যেমন কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, গ্রামীণ জীবনে ঈদ মানে আরো বেশি কিছু। ঈদ মানে ঐতিহ্যবাহী কিছু খেলার আয়োজন, যা চলে আসছে বহু যুগ ধরে।

তবে সেই প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী কিছু খেলা, যেগুলো গ্রামীণ জীবনের ঈদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেগুলোর উপরেও এবার প্রভাব ফেলেছে করোনাভাইরাস। বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে এবার দেশের নানান প্রান্তের নানান লোকজ উৎসব বাতিল হয়ে গেছে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় রেখে। পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে এমন সব লোকজ জনপ্রিয় খেলা, যেগুলো এবার হচ্ছেনা করোনার কারণে- তাই নিয়েই ‘বাংলা ইনসাইডার’ এর আজকের বিশেষ আয়োজন।

লাঠি খেলা

একটি ঐতিহ্যগত মার্শাল আর্ট যেটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু জায়গায় চর্চা করা হয়। লাঠি খেলা অনুশীলনকারীকে ‘লাঠিয়াল’ বলা হয়। এছাড়াও, লাঠি চালনায় দক্ষ কিংবা লাঠি দ্বারা মারামারি করতে পটু কিংবা লাঠি চালনা দ্বারা যারা জীবিকা অর্জন করে, তিনি/তাঁরা লেঠেল বা লাঠিয়াল নামে পরিচিতি পান।

লাঠি একটি প্রাকৃত শব্দ যেটি সংস্কৃত ‘ফর্ম ইয়াস্টি’ থেকে এসেছে। সুতরাং, লাঠি খেলাকে লাঠির কৌশল বলা যেতে পারে। দক্ষিণ এশীয় ভাষায় বাংলাসহ হিতোপদেশ আছে যে যার আছে লাঠি তার আছে ক্ষমতা। লাঠি খেলায় যে দক্ষ বা লাঠি খেলা নিয়ে যাদের বসবাস তারাও লাঠিয়াল হিসাবে পরিচিত।

লাঠিয়াল বাহিনী সড়কি খেলা, ফড়ে খেলা, ডাকাত খেলা, বানুটি খেলা, বাওই জাক (গ্রুপ যুদ্ধ), নরি বারী (লাঠি দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) খেলা এবং দাও খেলা (ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপহাস যুদ্ধ) খেলা দেখায়। এর মধ্যে ডাকাত খেলার উপস্থাপনা ঈদে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। লাঠিখেলার আসরে লাঠির পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোলক, কর্নেট, ঝুমঝুমি, কাড়া ইত্যাদি ব্যবহূত হয় এবং সঙ্গীতের সাথে চুড়ি নৃত্য দেখানো হয়।

লাঠি খেলার অসাধারণ ইতিহাস আছে। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা এখন পড়তির দিকে। ঈদ উপলক্ষে লাঠিখেলার আয়োজন সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, নড়াইল প্রভৃতি জেলায় ভিন্ন নামে দেখা যায়। লাঠি খেলা নিয়ে বর্তমানে নতুন দল তৈরি হচ্ছে না। এছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেও লাঠি খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে। আর কালেভদ্রে দেশের যেখানে যেখানে অনুষ্ঠিত হতো এই খেলা, এবারের মহামারির কারণে তাও হচ্ছেনা।

নৌকা বাইচ

সবাই দলবেঁধে উঠে পড়েন নৌকায়। পা রাখার আগেই খেলোয়াড়রা যেন জয়ের কৌশল ঠিক করে নেন। নির্ধারিত পোশাক গায়ে পড়ে বৈঠা নিয়ে প্রস্তুত সবাই। নৌকার সামনে বসেন ঢোলক। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন ধরেন গান। পেছনে নৌকার হাল ধরেন একজন। ধারাভাষ্যকরের কণ্ঠে ভেসে এলো ‘চালাও নৌকা’। নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান নেওয়া লাল পতাকা হাতে প্রস্তুত দুই লাইনম্যান।

ঘোষকের আওয়াজ বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই যেন ঢোলকের ঢোলে বাড়ি পড়তে শুরু করলো। বৈঠা হাতে নৌকার দু’পাশে অবস্থা নেওয়া খেলোয়াড়দের বৈঠা মারাও শুরু। ঢোলের তালে তালে ছুটতে থাকে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নৌকাগুলো। এভাবে নৌকা বাইচে চলে ঈদ উৎসব।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের বাঙালি নদী কিংবা যশোরের কেশবপুরের কপোতাক্ষ নদীতে প্রতি ঈদে এই লোকজ খেলার আয়োজন করা হয়। তবে চলতি বছর করোনাভাইরাসের কারণে জনপ্রিয় এই প্রতিযোগিতা বাতিল করা হয়েছে।

কাবাডি

১৯৭২ সালে হা-ডু-ডু খেলাকে কাবাডি নামকরণ করা হয়। একই সময়ে খেলাটিকে বাংলাদেশের জাতীয় খেলার মর্যাদাও দেওয়া হয়। ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও লোকায়ত ঐতিহ্যের জন্যে এই খেলা আমাদের দেশের জাতীয় খেলার মর্যাদা পেয়েছে।বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খেলাটিকে আঞ্চলিক নামে অভিহিত করা হয়। যেমন- কপাটি, কাপাটি, ছি-খেলা, কবাটি ইত্যাদি।

কাবাডি উপস্থিত বুদ্ধি, শক্তি, সাহস,দম ও ক্ষিপ্রতার খেলা। দুটি পক্ষের আক্রমণ ও দম ধরে নানারকম ব্যঙ্গাত্নক ও রসাত্মক ছড়ার কারণে খেলাটি দর্শকদের মনে আনন্দ দেয়। ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি যেকোন জায়গায় যেকোন সময় আয়োজন করা যায়। শরীরচর্চা ও স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে খেলাটির উপযোগিতা অনেক। গ্রামাঞ্চলে খেলাটি অধিকতর জনপ্রিয় হওয়ায় খেলাটিকে গ্রামবাংলার খেলাও বলা হয়।

আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন উৎসবের অনুষ্ঠানে আমোদ -প্রমোদের জন্য কাবাডি খেলার আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে ঈদ,পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উপলক্ষে কাবাডি খেলার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ নানান জায়গায় প্রতি বছর নিয়ম করে কাবাডি আয়োজন করা হলেও এবারের ঈদে কোথাও আয়োজন করা হচ্ছেনা করোনাভাইরাসের কারণে।

ষাঁড়ের লড়াই

অতীতে বাংলাদেশে ঈদের সময়ে ষাঁড়ের লড়াই একটি প্রসিদ্ধ খেলা রূপে প্রচলিত ছিল। লড়াই করার জন্য ষাঁড় গরু আলাদাভাবে লালন পালন করা হতো। এর দ্বারা হাল চাষ বা অন্য কোন ধরনের কাজ করা হতো না। ষাঁড়টিকে মোটাতাজা করা হতো শুধু লড়াই করার জন্য। শুকনো মৌসুমে গ্রামের বাজারে ঢোল পিটিয়ে ষাঁড়ের লড়াই দেখার আমন্ত্রন জানানো হতো। মাঠে ষাঁড়ের মালিকগণ তাদের ষঁড়গুলোকে বিভিন্ন রঙিন কাপড়, ঘুংগুর, দোয়াল দিয়ে গেঁথে নিয়ে আসতেন। দুদিকে দুজন রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসে দুপক্ষের ষাঁড়কে ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলে ঢাক ঢোল পিটিয়ে ও বিভিন্ন তালে তালে গান করত।

বাংলাদেশে এখনো কিছু কিছু স্থানে উৎসবের সাথে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে নড়াইলের সুলতান মেলায় এই প্রতিযোগিতা এখনো বিপুল জনপ্রিয়। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে বিগত ২০ বছর ধরে নড়াইল-যশোরের সীমান্তবর্তী বর্ণি-বিছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়িতে আসে। সকলে মিলে আনন্দ উপভোগ করতেই এই আয়োজন করা হয়। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিগত ২০ বছর ধরে এ এলাকায় ষাঁড়ের লড়াইয়ের আয়োজন করা হচ্ছে। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতার আয়োজন-ও স্থগিত করা হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে।

বাংলা ইনসাইডার/এসএম



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭