ইনসাইড থট

মুক্তিযুদ্ধ, হজ্ব ও ডা. জাফরুল্লাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 27/05/2020


Thumbnail

হঠাৎ করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান দেখানো, তাঁদের সম্পর্কে কথা বলার সময় একটু সতর্ক হওয়া, ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর কথা শুরু হয়েছে। এদের অধিকাংশই তাঁরা, যারা বিগত কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চরম নোংরা কথা বলেছেন। সেই গ্রুপ হঠাৎ করেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তথাকথিত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবরে তাঁর চিকিৎসা নিয়ে, স্বাস্থ্য নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। কীভাবে রাষ্ট্র একজন মুক্তিযোদ্ধাকে উপযুক্ত সম্মান দেখাবে তাঁর বিস্তারিত ও চুলচেরা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। খুশি এই কারণে যে যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় অশ্রাব্য ভাষায় মুক্তিযোদ্ধাদের গালিগালাজ করেছেন তাঁদের হয়তো হুশ ফিরেছে, যার অপর নাম চেতনা বা অন্তঃস্থিত অনুভূতি।    

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরা ভারতে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যারা প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধে যান তাঁদের ভিতর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল খুব প্রখর। তাই তাঁদের কর্মকাণ্ডে দেশ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এমতাবস্থায় কিছু ঝাঁকের কৈ ভারতে যান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অক্টোবর মাসের দিকে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ের পালে হাওয়া তখন বহু রাজাকার সারেন্ডার করেও মুক্তিযোদ্ধা বনে যান, তাঁরা মূলত শেষ ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তি বার্তায় তাঁদের নামও আছে।   

আমাদের দেশের বামেরা বুর্জেয়াদের সুসংগঠিত শক্তিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনা করেন এবং ‘শক্তির ভারসাম্য’ রক্ষার জন্য তাদেরকে সহযোগিতা করার নীতি এবং তাদেরকে প্রগতিশীলে রূপান্তরিত করা তারা বরাবরই ফরজ কাজ হিসেবে ধরে থাকেন। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হলে সিপিবি’র প্রধান ভূমিকা ছিল ভারতে গিয়ে অবস্থান নেওয়া ও সোভিয়েত নীতি অনুযায়ী ভূমিকা গ্রহণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার ফলে সিপিবি’র কেন্দ্রীয় ভূমিকাও ছিল সেভাবে দ্বিধাগ্রস্ত। তবে অক্টোবরে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রী চুক্তি হলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে সিপিবি’র চিন্তা চেতনা পাল্টে যায়।     

এর আগেই অবশ্য অন্যান্য বামপন্থী সংগঠনগুলোর মতো সিপিবি’র বেশ তরুণ কিছু তরুণ কর্মী ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এর অংশ হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষাশেষি সেক্টর টু রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হন।  তিনি মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এর পরামর্শে ডা. এম এ মবিনের সাথে মিলে আগরতলার মেলাঘরে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” পরিচালনা করেন।  

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সিপিবি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ‘প্রগতিশীল নীতি অনুসরণকারী দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে তারা সাদরে গ্রহণ করেন এবং আওয়ামী লীগ যা কিছুই করুক না কেন তাতে তারা সমর্থন করতে থাকেন ‘রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে’। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পতন পরবর্তী দলে ভাঙনের সময়ে তারা নিজেদের নীতি আদর্শের সঙ্গে ‘ডাংগুলি খেলায়’ মাতেন। জিয়াউর রহমান সরকারের ১৯ দফা কর্মসূচিতেও সিপিবি সরকারের প্রগতিশীলতার উপাদান খুঁজে পায় এবং এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে খালকাটা, গণভোট, সংসদ নির্বাচন কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এসবেও ‘শক্তির ভারসাম্য’ তাদের সিদ্ধান্তের পিছনে এক মহান যুক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

এবার কিছু চৈনিক বামদের কথায় আসি। ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানী হানাদাররা ভারত পাঠায়৷ তাদের লক্ষ্য, ভাসানীকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা,  তা নাহলে বার্মা কিংবা চীনে পাঠিয়ে দেয়া৷ এই খবর পেয়ে ভাসানী ঢাকায় ফেরার জন্য, আরও আগ্রহী হন চীনের কথা শুনে যে দেশটি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করছে না৷ বিষয়টি ভারত সরকার জেনে ভাসানীকে দিল্লীর হাসপাতালে ভর্তি করে৷ তখন রেডিও পাকিস্তান প্রচার চালায় যে, ভারত ভাসানীকে গৃহবন্দী করে রেখেছে৷    

এর ফলে ২৪ মে ১৯৭১ কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে যাদু বিফল হয়ে ফিরে আসেন৷ পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে অক্টোবরে জামাতের সাথে মিলে উপনির্বাচনে অংশ নিতে সভা সমাবেশ করেন, মুক্তিযোদ্ধা নিধনের আহবান জানান৷    

মুজিবনগর সরকারের চাপে পড়ে ভাসানী সেক্রেটারি পদ হতে যাদু মিয়াকে মৌখিকভাবে বরখাস্ত করেন৷ ১৯৭২সালে দালাল আইনে বিচারে শুরু হলে যাদু মিয়ার দশ বছর জেল হয়৷ আর ভাসানী তখন এই আইন বাতিলের দাবিতে  অনশনও করেন৷ যার সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন অনেক বুদ্ধিজীবী যোগ দেন, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ‘আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর’এর লেখক আবুল মনসুর আহাম্মেদ।

ভাসানীর জোর দাবিতে ১৯৭৫এর সেপ্টেম্বরে যাদু মিয়াকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ ভাসানী মোশতাককে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতিও দেন৷ যাতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কুৎসা নিন্দা-মন্দে ছিল ঠাঁসা৷ 

ভাসানীর মৃত্যুর পর যাদু মিয়া পুরো দল নিয়ে জিয়ার জাগদলে ঢোকেন৷ ১৯৭৭সালে জিয়া তাকে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় সিনিয়র মন্ত্রী করেন৷, সংবিধানে যে পদের অস্তিত্ব ছিল না৷ যাদু মিয়াঁর অনুসারীরা মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী ও হানাদারদের সহযোগী ছিল৷ এখানে উল্লেখ্য যে, যাদু মিয়ার জামাতা মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারি৷ 

ধর্মীয় চেতনায় জারির আমাদের দেশের মুসলমানদের অধিকাংশই মক্কায় যান হজ্ব করে নিজেকে পরিশুদ্ধ, পবিত্র করে অন্যায় থেকে ভবিষ্যতে নিজেকে দূরে রাখার শপথ নিতে, আল্লাহ্‌র ঘর কাবা শরিফে। এঁদের মধ্যেও কেউ কেউ ব্যবসার জন্য হজ্বে যান, কেউ যান নিজের ইমেজ পরিষ্কার করতে। ফিরে এসে যদি কোন হাজী সাহেব তাঁর নৈতিক স্খলনের জন্য, খুন, ডাকাতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হন তখন কি তিনি আর হজ্বের চেতনায় থাকেন? তাঁকে কি আর সত্যকারে হাজী বলায় যায়? যায় না, কিন্তু হজ্বে যাবার সমস্ত দলিল তাঁর কাছে থাকে। তিনি দাবি করতেই পারেন যে, তিনি হাজী কিন্তু বাস্তবে হজ্বের চেতনা বিচ্যুত হাজী সাহেব। 

আমাদের দেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা ১৯৭১ সালের পরে পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের সাথে, ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধী, খুন ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ কারীদের সাথে এখন মিলে একাকার হয়ে গেছেন। তাঁদের সার্টিফিকেট থাকলেও কি আমরা তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা বলতে পারি? তাঁরা কি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনায় আছেন? মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম উপদেষ্টা বা অন্যতম কর্ণধার বলা যায়। উনার করোনায় আক্রান্তের খবরে বেগম খালেদা জয়া ফল আর ফুল পাঠিয়েছেন।  সপ্তাহে ৩ বার কিডনির ডায়ালোসিস করা মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত। তাঁকে যে কোন পি সি আর মেশিনে চেস্ট করে করোনা সংক্রমণ নিশ্চিত হতে বলা হলেও তিনি তা করতে অস্বীকার করেছেন। নিজের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় আছেন, কেন? তিনি কি কয়েকদিন পরে ভি চিহ্ন দেখাতে চান যেমনটি করেছিলেন মানবতা বিরোধী অপরাধীরা আদালত কর্তৃক ফাঁসির দণ্ডের আদেশ পাবার পরে!     

তথ্য ঋণ: সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট, ইত্যাদি।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭