নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 21/07/2017
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীনতা লাভ করেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে দীর্ঘ সংগ্রাম, তার বীজ নিহিত ছিলো এদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষকসহ আপামর জনসাধারণের মধ্যে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাঙালি তার অপরিচয়ের সংগ্রাম সূচনা করে ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।এই ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মাঝ থেকে, সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি ধারায় এদেশের ছাত্রছাত্রীরা অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। তাই লক্ষণীয় যে, পাকিস্তান শাসনামলে শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য ছিলো বাঙালির অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের বিপরীতে একটি সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন। এর প্রতিবাদে শুরু হয় বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাঙালি জাতি। কিন্তু স্বাধীনতার যে ব্যপ্ত অর্থ, সে অর্থে আমরা এখনও স্বাধীন হয়েছি কি? এ প্রশ্ন এখনও, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও প্রাসঙ্গিক।
স্বাধীনতার পর পরই হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তানি ছায়া-সরকার। বস্তুত পঁচাত্তরের পর থেকেই আমাদের সংবিধান ও শিক্ষাব্যবস্থার উপর একের পর কাঁচি চালাতে শুরু করে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও তাদের তাঁবেদার সরকারগুলো। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তককে তখন ব্যবহার করা হয়েছিলো রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। পঁচাত্তরের পর তিনটি প্রজন্ম বড়ো হয়েছে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাব্যবস্থা কেন্দ্রীক অপরাজনীতির ভিতর দিয়ে। ছিয়ানব্বই সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মুক্তিযুদ্ধের কিছু মৌল বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো, কিন্তু গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় তার কোনো প্রভাব পড়েনি। ২০০১ সালে বিএনপি-রাজাকার জোট ক্ষমতায় এসে আবার পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে। সম্প্রতি ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনগুলো একটি ভয়াবহ দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ্যপুস্তকের রাজনীতিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।
১৯৪৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত, এই ৭০ বছরে মোট ১১টি শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে কোনটি বাতিল হয়েছে, কোনোটির আংশিক গৃহীত হয়েছে,কোনটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে; কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে কোনো শিক্ষা কমিশনই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতে পারেনি। ১১টি শিক্ষা কমিশনের মধ্যে ৭টি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। । স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টগুলো থেকে বোঝা যায়, একমাত্র কুদরত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্টেই রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূল নীতির প্রতিফলন ঘটেছিলো (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ)। স্বাধীনতার মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই এই কমিশন তৈরি হয়েছিলো। এরপর যে কমিশনগুলো তৈরি হয়েছিলো, সেগুলো এই কমিশনেরই বিভিন্ন সুপারিশ গ্রহণ বর্জন বা পরিবর্তন।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন অসাম্প্রদায়িক হলেও, তাতে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির প্রতিফলন ঘটেনি। ২০১৭ সালে যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ হলো, এতে ভয়াবহ রকমের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত ও প্রকাশিত মোট ৭৮টি পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে যে আত্মঘাতী পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণই উগ্র ধর্মভিত্তিক তিনটি দলের সুপারিশে। তাদের সুপারিশ সম্পূর্ণ মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে মোট ২৯ ধরনের পরিবর্তন এনেছে এনসিটিবি। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই ছাপা হবার পর যখন দেখা গেলো হেফাজতের দাবি মতে উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর রামায়ান-কাহিনী ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লালু বাদ পড়েনি, তখন চার কোটি টাকা মূল্যের ১৫ লক্ষ বই বাতিল করে আবার তা ছাপানো হয়, যেনো হেফাজতের দাবি নিখুঁতভাবে মানা হয়। সরকারের কী নির্লজ্জ মৌলবাদ তোষণ! সম্প্রতি সর্ব মহলের তীব্র প্রতিবাদ ও সরকারের হেফাজত নীতির কঠোর সমালোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তারা পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সে সংশোধন আসলে কোন পর্যায়ের তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য আসেনি। বছরের অর্ধেক সময় চলে গেছে, এখন তারা কীভাবে সংশোধন করবেন, না কি কেবল কথার কথা বলছেন— সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। যেখানে প্রশ্ন উঠেছে অনেক সুনির্দিষ্ট বিষয় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বাদ দেয়া নিয়ে এবং হেফাজতের মতো উগ্রবাদী দলের পরামর্শে নানা বিষয় সংযোজন করার বিষয়ে, সেখানে সরকার কি কেবল ছাগলকে গাছ থেকে নামিয়ে আর ‘ও’- তে ওড়না’র বদলে অন্য কোনো শব্দ দিয়ে দায় সারতে চাইছে? বিষয়টি নিয়ে এখন থেকেই আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে, না হলে আগামী বছরও জনগণের টাকা খরচ করে সরকার হেফাজতের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করবে।
দুই
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বহু বাধাবিভক্ত এবং চরম বৈষম্যমূলক। সে বৈষম্য স্কুল-মাদ্রাসায় যেমন প্রকট, তেমনি প্রকট শহর-গ্রামেও। কিন্তু সবচেয়ে বড় বৈষম্য ধনী-গরিবের জন্য শিক্ষার আলাদা আলাদা ব্যবস্থায়। ধনি ও শাসক শ্রেণির সন্তানরা দেশে প্রচলিত কোনো ব্যবস্থাধীনেই লেখাপড়ায় আগ্রহী নয়। তারা বিদেশে উন্নত লেখাপড়ায় আগ্রহী অথবা দেশেই বিদেশী ভাষায় বিদেশী কারিকুলামে তাদের শিক্ষালাভ হয় সে শিক্ষা এতটাই ব্যয়বহুল যে, সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ তা কল্পনাও করতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, ধনি ও শাসক শ্রেণীর সন্তানদের জন্য মাতৃভাষা বাংলা চর্চা যেন নিষিদ্ধ এবং এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের ন্যূনতম যোগসূত্র নেই। তাদের কাছে মাতৃভাষা বাংলা যেনো ব্রাত্য। জীবনে উন্নতির জন্য মাতৃভাষা বাংলাকে তারা প্রধান অন্তরায় বলে মনে করে। বাংলাদেশের এ তথাকথিত এলিট শ্রেণী গোটা জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা সহ সার্বিক উন্নয়নের পথে অনেক বড়ো অন্তরায়। বস্তুত সমাজ জীবেনের নানা ক্ষেত্রে চুড়ান্ত বৈষম্যগুলো শিক্ষা ব্যবস্থাতেও তার আঁচড় ফেলছে। একটি ভাঙ্গাচোড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে অবলম্বন করে ৭৫- এর পর থেকে এতোকাল অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। দিনে দিনে এই বৈষম্য বাড়ছে, কেননা শিক্ষাকে প্রতিটি সরকারই পণ্য হিসেবে জনসাধারণের কাছে বিক্রি করেছে। শিক্ষা যে আমাদের সংবিধান স্বীকৃত মৌল অধিকার, সে কথা যেনো তারা বেমালুম ভুলে গেছে। সুতরাং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে প্রথমেই মনে হয়, এর অভ্যন্তরস্থ সকল বৈষম্যগুলো আগে দূর করতে হবে। এই যে শিক্ষার নানা ধারা উপধারা রয়েছে, তা থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতে হবে। একমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে না পারলে আমরা
কেবল পিছিয়েই যেতে থাকবো।
অর্থনৈতিক নানা সূচকে হয়তো আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বা রিজার্ভের অঙ্ক শুনে হয়তো আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি; কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যে গোঁজামিলের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বড়ো হচ্ছে, তাতে সচেতন যে কোনো নাগরিকই শঙ্কিত হবেন। কিন্তু শঙ্কাকে জয় করতে চাইলে দরকার প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। সরকার জনগণের টাকায় শিক্ষা নিয়ে যে ছেলেখেলা শুরু করেছে, তার প্রতিবিধানের জন্য আমাদেরই ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলতে হবে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, শিক্ষাই যে একটি জাতির অগ্রগতির প্রথম সোপান, সেটা যেনো কেবল কথার কথা হয়েই না থাকে।
বাংলা ইনসাইডার
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭