ইনসাইড আর্টিকেল

বঙ্গবন্ধুর আত্মার আত্মীয় মানিক মিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 01/06/2020


Thumbnail

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া একজন প্রতিথযশা সাংবাদিক, লেখক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৬৯ সালের এই দিনে ১ জুন মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ক্ষণজন্মা এই সাংবাদিক।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমার মানিক ভাই’ নিবন্ধে লিখেছেন- ‘রাজনীতি সম্পর্কে মানিক ভাই’র ধারণা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন মানুষের অধিকারের বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। তখন মানিক ভাই’র মাঝে এদেশ এবং দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি যে ভালবাসা লক্ষ্য করেছি, তা আমাকে অভিভূত করেছে। মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং অনুভূতির প্রখরতা এত সুগভীর ছিল যে, মানুষ কি চায়, কি ভাবে- সহজেই তিনি তা বুঝতে পারতেন এবং তা’ তুলে ধরতেন লেখনীর মাধ্যমে।’ (অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া, পৃ ৯) বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতেন, তাঁকে আস্থার জায়গা ও রাজনৈতিক দিকদর্শক মনে করতেন।

বাংলার মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তিনি নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মানুষের কথা কলমের মুখে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ধারণ করেছিলেন ‘মোসাফির’ ছদ্মনাম। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে তিনি জেল খেটেছেন কয়েক বছর। সাংবাদিকতা জগতের এই নক্ষত্রসম ব্যক্তিত্ব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সাথে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল অনেক নিবিড়। একবারে আত্মার আত্মীয়। তাঁরা একসাথে থেকেছেন বিপদে-আপদে। দেশের কথা, মানুষের কথা ভেবেছেন একসাথে। ভেবেছেন এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই পরম রাজনৈতিক বন্ধু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কথা বলেছেন তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামক গ্রন্থে। তিনি তাঁদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের কথা বলেছেন এভাবে—একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেয়ে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, নানা অসুবিধায় আছি, আমাদের দিকে খেয়াল করার কেউ নাই। আমি কি আর করতে পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কি বলেন। আমি (বঙ্গবন্ধু) বললাম, মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবারও কেউ বোধহয় থাকবে না। আমি জানতাম মানিক ভাই চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছেন। ছেলেমেয়েদের পিরোজপুর রেখে তিনি একলাই ঢাকায় আছেন। মানিক ভাই কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, না, যাব না আপনাদের জেলে রেখে।

এরপর ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠা এবং তা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার সূক্ষ্ম কৌশল, নিরলস পরিশ্রম ও মানিক মিয়ার অসামান্য সাফল্যের কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর উপর্যুক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মওলানা সাহেব সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ বের করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ বের হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ টাকা কোথায়? মানিক ভাইকে বললেন, কাগজটা তো বন্ধ হয়ে গেছে, যদি পার তুমিই চালাও। মানিক ভাই বললেন, কি করে চলবে, টাকা কোথায়, তবুও চেষ্টা করে দেখব। আমি মানিক ভাইকে আমার এক বন্ধু কর্মচারীর কথা বললাম, ভদ্রলোক আমাকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। কলকাতায় চাকরি করতেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের বাসিন্দা নন, তবুও বাংলাদেশ ও তার জনগণকে তিনি ভালোবাসতেন। আমার কথা বললে কিছু সাহায্য করতেও পারেন। মানিক ভাই পরের মামলার তারিখে বললেন যে, কাগজ তিনি চালাবেন। কাগজ বের করলেন। অনেক জায়গা থেকে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল। নিজেরও যা কিছু ছিল এই কাগজের জন্যই ব্যয় করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে কাগজটা খুব জনপ্রিয় হতে লাগল। (পৃ. ১৭৪-১৭৫)।

বঙ্গবন্ধু একবার তাঁর সঙ্গে চীন সফরের কথাও বলেছেন এ কালজয়ী গ্রন্থে। তিনি বলেন, ১৯৪৯-এর সেপ্টেম্বর মাসের ১৫-১৬ তারিখ খবর এল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিরা শান্তি সম্মেলনে যোগদান করবে। স্লোগান হলো, ‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই’। আমাদেরও যেতে হবে পিকিংয়ে, দাওয়াত এসেছে। সমস্ত পাকিস্তান থেকে ত্রিশজন আমন্ত্রিত। ...মানিক ভাই বলতে শুরু করেছেন, তাঁর যাওয়া হবে না, কারণ ইত্তেফাক কে দেখবে? টাকা কোথায়? ইত্তেফাকে লিখবে কে? কিছু সময় পর খবর পেলাম চব্বিশ ঘণ্টা প্লেন লেট। আগামী দিন বারোটায় প্লেন আসবে, একটায় ছাড়বে। মানিক ভাইকে অনেক করে বললাম, একটু করে রাজি হলেন, তবে ঠিক করে বলতে পারছেন না। পরের দিন সকালে প্রস্তুত হয়ে আমি (বঙ্গবন্ধু) মানিক ভাইয়ের বাড়িতে চললাম। তখন ঢাকায় রিকশাই একমাত্র সম্বল। সকাল আটটায় যেয়ে দেখি তিনি (মানিক ভাই) আরামে শুয়ে আছেন। অনেক ডাকাডাকি করে তুললাম। আমাকে বলেন, কী করে যাব, যাওয়া হবে না, আপনারাই বেড়িয়ে আসেন। আমি রাগ করে উঠলাম। ভাবিকে বললাম, আপনি কেন যেতে বলেন না, দশ-পনের দিনে কী অসুবিধা হবে? মানিক ভাই লেখক, তিনি গেলে নতুন চীনের কথা লিখতে পারবেন, দেশের লোক জানতে পারবে। কাপড় কোথায়? সুটকেস ঠিক করেন। আপনি প্রস্তুত হয়ে নেন। আপনি না গেলে আমাদেরও যাওয়া হবে না। মানিক ভাই জানে যে আমি নাছোড়বান্দা। তাই তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিলেন। এরপর তাঁরা চীনে গেলেন। শান্তি সম্মেলনে যোগ দিলেন।

ছয় দফা থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর যে স্বাধীনতা আন্দোলন, সেই আন্দোলনে জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন মানিক মিয়া। তাঁর মতো দেশপ্রেমিক সাংবাদিকদের সারা জীবন অনুসরণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেকোনো সমস্যায় মানিক মিয়ার কাছে ছুটে যেতেন। দুজনে পরামর্শ করতেন। এরপর বঙ্গবন্ধু মাঠে নামতেন। আর মানিক মিয়া কলাম লিখতেন। এভাবেই স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে এগিয়েছি।

একজন সাংবাদিক মানিক আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে রেখে গেছেন তাঁর সংগ্রামী জীবনের অসীম অনুকরণীয় আদর্শ। কীভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বিপদে-আপদে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় তা আমারা জেনেছি এই মহান পুরুষের কাছে। যতদিন এই বাংলাদেশ রবে, মানিক মিয়া আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন। মানবতার পরম বন্ধু প্রিয় মানিক মিয়াকে কোনোদিনও ভোলা সম্ভব নয়।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭