ইনসাইড থট

দেশপ্রেমিক আমলা ও নিতাইয়ের গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 01/06/2020


Thumbnail

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও মূল ৩ টি অংশ- একটি হচ্ছে আইন বিভাগ, অপরটি বিচার বিভাগ আর প্রশাসন। প্রশাসনের আবার আছে দুটি অংশ একটি হচ্ছে রাজনৈতিক আর অপরটি আমলা অংশ।  প্রশাসনের রাজনৈতিক অংশে থাকেন, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী। আর আমলা অংশে থাকেন একদল সিনিয়র সচিব আর সচিব বা সচিব পদমর্যাদার আমলা, ইত্যাদি। তাঁরা মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রধান ও একাউন্টিং হেড। তাঁরা সরকারের সকল নীতি ও কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রাপ্ত। সেই হিসেবেই করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ বা অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় ত্রাণ বিতরণে আমলাদের হাতে সরকার প্রধান ক্ষমতা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা এই কাজে কতটুকু দক্ষ! কাজ করা হচ্ছে তাঁদের নামে কিন্তু বাস্তবে কাজ করছেন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিগন।
  
বাংলাদেশে সরকারী অফিস ৮ ঘণ্টার। জন-গুরুত্বপূর্ণ কিছু দপ্তর যারা অত্যাবশ্যকীয় পরিসেবার আওতায় পড়েন তাঁরা ছাড়া সবাই ৮ ঘণ্টার বেশি অফিস করতে বাধ্য নন। বিকেল ৫ টার পরে তাঁদের ফোন করলে ফোন ধরেন না, কোন ফাইলে সই করেন না যদি না প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কোন নির্দেশ যায়। সপ্তাহে তাঁর দুই দিন ছুটি ভোগ করেন। এছাড়াও সরকারী অন্যান্য ছুটি তাঁরা ভোগ করে থাকেন। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের বাস্তবে কোন অফিস টাইম নেই, ছুটি নেই। বরং সন্ধ্যার পরে তাঁর কাজের চাপ আরও বাড়ে। একজন আমলা যেমন ১৬ /১৭ বছর নিরলস পড়াশুনা করে বি সি এস পরীক্ষা দিয়ে একবার চাকরি পেলে তাঁর আর তেমন কোন পরীক্ষা দিতে হয় না। কাজ একটু ভালো করলে, মন জুগিয়ে চললে সচির হয়ে যান। ঠিক একইভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী কিছু ব্যতিক্রম বাদে ২০/২৫ বছর মানুষ ও সমাজ থেকে রাজনীতির পাঠ নিয়ে, প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে সাংসদ হবার টিকেট পান দল থেকে। তাঁকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়। একটা ভুল করলেই ৫ বছর পরে তাঁর চাকরি নট। কিন্তু আমলারা জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করলে জনস্বার্থে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়। ভাবটা এমন যে, যেখানে বদলি করা হল সেখানে কোন জনমানব নেই। 
 
পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশেই সংসদ সদস্যদের বেশীরভাগ হন আইনজীবী বা ঝানু পলিটিশিয়ান যারা আইনের মূল বিষয়টাও খুব ভালো বোঝেন। যে সব আইনজীবী সাংসদ হন তাঁদের মধ্যেও ভাগ থাকে,পরিবেশ, বিনিয়োগ, শ্রম আইন, ইত্যাদি আইনে অভিজ্ঞ আর প্র্যাক্টিশনার। বাংলাদেশের ৩৫০ (৩০০+৫০) জন সাংসদ বা সংসদ সদস্যদের কাগজে কলমে কাজ মূলত: আইন প্রণয়ন করা। তাই আইন সম্পর্কে বেসিক ধারণা ছাড়া আইন প্রণয়ন করতে গেলে হয় ভুল। এসব ভেবে তাই যাতে করে তাঁর কাছে ঐ খাতের পুরো চিত্র থাকে কোন না কোন ভাবে। এর বাইরেও সংসদে আনা হয় নানা পেশাজীবীকে যাতে করে তারা সংশ্লিষ্ট পেশার সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়ে প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করতে সহায়তা করতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলো এমনভাবেই নমিনেশন দেন যাতে ক্ষমতায় গেলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের অসুবিধায় না পড়তে হয়। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি সাংসদকে ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ’ সবই করা লাগে।  
উচ্চ পদের আমলারা সাধারণত যে কোন দেশের রাজধানীতে থাকেন, গ্রামের বা শিল্প এলাকার কলকারখানার ছোটখাটো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সাথে তাদের নিবিড় যোগাযোগ থাকে না। সেখানে তাঁদের পক্ষে কাজ করেন তাঁদের অধীনস্থ দপ্তরের কর্মীরা। তারা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে নীতি বাস্তবায়নের কাজ করেন। আমাদের দেশে সব বিশেষজ্ঞদের মতোই একজন পল্লী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ সারাটা সময় কাটান শহরে উনাকে দিয়ে এককভাবে পল্লী উন্নয়ন বা এমন কোন শহুরে বিশেষজ্ঞকে দিয়ে কোন খাতের উন্নয়নের নীতি বা আইনের খসড়ার পরামর্শ নেওয়া হয়, কিন্তু উন্নত দেশে নেওয়া হয় না। কারণ গ্রামীণ সমাজের রূপ প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে গ্রামীণ সমাজের পাওয়ার ফ্যাক্টর। কলকারখানার কর্ম-পরিবেশ বদলাচ্ছে। স্থায়ীভাবে গ্রামে বাস না করলে গ্রামের আসল চেহারা বা রূপ আর তাঁর সমস্যা এক বা দুই সপ্তাহ গ্রামে থেকে পাওয়া যায় না। উন্নয়নের ফ্যাক্টরের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। সেই সেক্টরের সাথে আধা নিবিড় বা নিবিড়ভাবে কাজ না করলে তার মূল সমস্যা আর তার সমাধানের কার্যকর পন্থা নিয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সবার থাকে না। যারা আইনের পেশার সাথে জড়িত, তারা আদালতের বিভিন্ন মামলায় যোগ দিয়ে সমস্যার কিছুটা অন্তত গভীরে যেতে পারেন বা যাবার সুযোগ পান। সে কারণে তাঁদের দিয়ে আইন প্রণয়ন অনেকটাই ভালো হয়।   

ব্যবসায়ী আর অবসরপ্রাপ্ত আমলারা এখন দলে দলে রাজনীতিতে ঢুকছেন বাংলাদেশে। সংবিধানের আলোকে আইন করার কথা। সেই পার্লামেন্টের আইনের অধীন অধঃস্থ আইন বা স্থানীয় সরকার আইন/ বিধি প্রণয়ন বা তৈরি হয়। আইনের / বিধির খসড়া তৈরির সময় সেখানে যুক্ত হচ্ছেন মূলত: একটু ইংরেজি ও বাংলা ভালো জানা আমলারা, সত্যিকার অর্থেই রাজনীতিবিদরা নন যদিও তাঁদের নামেই হচ্ছে সবকিছু। কারণ তাদের অনেকের (সবার নয়) প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সীমাবদ্ধতা আছে। তারা মানুষের কল্যাণের কাজে, উন্নয়নের কাজের সমন্বয়ে খুব ভালো হলেও লেখা পড়ায় দুর্বল। সেই সুযোগ নিয়ে আইন প্রণয়নের সময় এমন সব শব্দের প্যাঁচ লাগানো হচ্ছে যাতে করে রাজনীতিবিদের কাজ আর জীবন হয় খুব কঠিন, আমলা আর ব্যবসায়ীরা দিন দিন হয় শক্তিশালী। আর প্রতি বছর বাজেটের পরে কয়েকশত ব্যবসায়ী আর তাদের সহযোগী হন কোটিপতি। পরে অবশ্য ধরাও পড়েন। কিন্তু এখন আমলাদের খসড়া করা আইনের ফাঁক এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, সরকার বদলালে রাজনীতিবিদরা যাচ্ছেন জেলে, কিন্তু তাঁর মন্ত্রণালয়ের আমলারা তাদের নির্বাহী প্রধানরা থাকছেন ধরা ছোঁয়ার একদম বাইরে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদরা যারা সাংসদ তাঁরা আইনের খসড়া প্রণয়নে আমলাদের ব্যবহার করে, ম্যানেজ করে এমন সব আইনের খসড়া করছেন/আইন পাশ করছেন যাতে ব্যবসায়ীরাই লাভবান হন, আমলারা নিরাপদ থাকেন, আর বিপদে থাকেন পেশাদার পোড়-খাওয়া রাজনীতিবিদরা। তাই তো দিনে দিনে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। 

১৯৪৬ এ অবিভক্ত বাংলার শেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে লক্ষণীয় আইনজীবী-রাজনীতিকদের উপস্থিতি রয়েছে। ১৯৫৪ এ পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে আগের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, ব্যবসায়ী যুক্ত হয়েছে, তবে তা মাত্র ৪% অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ নির্বাচন-১৯৭০ : জাতীয় (ও প্রাদেশিক পরিষদে) আইনজীবী-রাজনীতিকদের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মত। এরপরের চিত্রটা হলো, প্রথম সংসদ-১৯৭৩ : ১৩% ব্যবসায়ী; ২য় সংসদ-১৯৭৯ : ৩৪% ব্যবসায়ী, সপ্তম সংসদ-২০০১ : ৫১% ব্যবসায়ী; অষ্টম সংসদ-২০০৮ : ৬৩% ব্যবসায়ী; নবম সংসদ-২০১৪ : ৬৩% ব্যবসায়ী। বর্তমান অবস্থা আরও খারাপ।
 
মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই লৌহ, তাম্র, ইত্যাদি নানা যুগ পেরিয়ে দাসদের ব্যাবহার করে কৃষি, শিল্প বিপ্লব হলে পরবর্তীতে দুনিয়া জুড়ে আসে জনমানুষের তন্ত্র বা গণতন্ত্র। মানুষের কল্যাণেই নাকি এসব করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের নামে এসব নানা তন্ত্র মন্ত্র আমাদের চোখের সামনে এলেও গভীরভাবে দেখলে সব ছবি একই। সময় গড়িয়েছে অনেক, কিন্তু সামাজিক সেই প্রাচীন প্রথা সেই অর্থে বদলায়নি। শোষণ আর দাস প্রথা ভিন্ন ভিন্ন রূপে এখনো টিকে আছে না বলে, বলা যায় প্রথাটি আরো শক্তিশালী হয়েছে। শোষকরা হয়েছে অনেক বেশী কৌশলী, ক্ষমতাবান। এটা এমন যে, বাঘ মারে নিতাই নাম হয় শংকরের, কারণ নিতাই গরীবের ছেলে, আর শংকর জমিদারের সন্তান। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ্গন বাস্তবে সবাই আজ নিতাই। রাত দিন কাজ করার পরেও তাঁদের কোন সুনাম নেই সব বদনাম, আর সুনাম হচ্ছে আমলাদের।    
     



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭