ইনসাইড থট

পাটকল বন্ধ: প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 29/06/2020


Thumbnail

সোনালী আঁশের দেশ বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট দিয়ে তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাস্তবতা হলো, বছরের পর বছর দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে লোকসান গুনছে। কিন্তু পাশের দেশ ভারত বাংলাদেশ থেকে পাট কাঁচামাল হিসেবে কিনে সেটা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে বিক্রি করছে এবং মুনাফা গড়ছে, আর একটার পর একটা নতুন পাটকল তৈরি করে যাচ্ছে। বিশ্বে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় কিন্তু রপ্তানিতে ১ম। অন্যদিকে ভারত পাট উৎপাদনে ১ম, পাটজাত পণ্য রপ্তানিতেও প্রথম।    

ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এই অঞ্চলে পাটের চাষ হলেও এখানে প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালের মাঝামাঝিতে নারায়ণগঞ্জে। বেসরকারি পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত এই মিলটির নাম ছিলো বাওয়া পাটকল। পরবর্তীতে এই সময়েই একই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী পাটকলের। এর পরপরই কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে অসংখ্য পাট শিল্প কারখানা, ১৯৬০`এ যার সংখ্যা ছিল ১৬টি ও ১৯৭১ সালে যা দাঁড়ায় ৭৫টিতে। ২০১৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত হিসেবে বাংলাদেশে মোট ৩১৪টি পাটকল। এর মধ্যে সরকারি –বেসরকারি মিলিয়ে ৬৩টি পাটকল বন্ধ ছিল।    

অব্যাহত লোকসানের মুখে অবশেষে ২৮ জুন রবিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। এগুলো পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় চলবে। তিনি জানান, সরকারি ২৫টি পাটকলে এই মুহূর্তে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিক রয়েছেন। তাদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসর দেওয়া হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিও পাওয়া গেছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে বলেও জানান পাটমন্ত্রী। গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছেন, সরকারের পক্ষে বছরের পর বছর পাটকলের এত লোকসান বহন করা সম্ভব নয়। পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, গত ৪৮ বছরে সরকার এই পাট খাতে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।

২০০৪-৬ সালে জাপানী অর্থ সাহায্যে এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন (এপিও) ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের  অধীন বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন (এনপিও) যৌথভাবে বাংলাদেশের পাটকলগুলোর লোকসানের কারণ অনুসন্ধান ও তা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে কাজ করে।  এপিও’র ড. সিনিচিরো কাওয়াগুচির নেতৃত্বে একটি দল অপরপক্ষে এনপিও’র  পরিচালক ড. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি দল বাংলাদেশের জুট মিল মালিকদের সংগঠন বিজেএমএ ও জুট স্পিনার্স এসোসিয়েশনের সাথে নিয়ে ৩ বছরের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এই প্রকল্পের আওতায় একটি খুব পুরাতন জুট মিল আরেকটি খুব আধুনিক জুট মিল বেছে নেওয়া হয়।    
 
এপিও ও এনপিও যৌথভাবে পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় মিল পরিচালনায় বাড়টি কোন অর্থ বরাদ্দ না নিয়েই কাইজেন ও ফাইভ এস কৌশল যৌথভাবে প্রয়োগ করে পুরাতন পাটকলটিতে প্রায় ২৪ % প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায় আর নতুন পাটকলটিতে ২.৫% প্রোডাক্টিভিটি বাড়িয়ে ফেলে। মূলত কর্মীদের মোটিভেশন দিয়ে পাটকলগুলো পরিষ্কার আর মেশিনগুলোর সঠিক যত্ন নিয়ে ও সময় ব্যবস্থাপনা করেই কালি বা ময়লা দূর করে, নালিকাটা কমিয়েই পাটকল দু’টিতে ওয়েস্টেজ কমিয়ে ফেলে। এতে পুরাতন পাটকল লোকসান থেকে লাভের মুখ দেখে। অন্যদিকে নতুন মিলটির সামান্য লাভ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এটা করা হয় ফাইভ এস আর কাইজেনের যৌথ প্রয়োগের মাধ্যমে।    
 
বেসরকারি অর্থাৎ বাংলাদেশের জুট মিল মালিকদের সংগঠনের সাথে এই প্রকল্প করার উদ্দেশ্য ছিল এই যে প্রডাকশন নয়, প্রোডাক্টিভিটি বাড়িয়ে বিশ্ব বাজারে পাটজাত পণ্যের বাজার ধরে রাখায় পাটকলগুলোকে যোগ্য করে তোলা। প্রকল্প শেষ হবার পরে বেসরকারি পাটকলগুলো এটা নিজ নিজ পাটকলে প্রয়োগ করা শুরু করে ভালো ফল পান। গবেষণায় দেখা যায় যে শুধুমাত্র ১% ওয়েস্টেজ কমানো গেলে ১৭% প্রোডাক্টিভিটি বেড়ে যায়।    

এই অবস্থার প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২ অক্টোবর রূপসী বাংলা হোটেলে জাতীয় বহুপাক্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। ঐ সম্মেলনে তিনি ৩টি ঘোষণা দেন। ১. উৎপাদনশীলতাকে জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ঘোষণা ২. প্রতি বছর ২ অক্টোবরকে জাতীয় প্রোডাক্টিভিটি ডে ঘোষণা ৩. লার্জ, মিডিয়াম, স্মল, কটেজ, মাইক্রো ও ন্যাশনালাইজড এই ৬ ক্যাটাগরির ইন্ডাস্ট্রিগুলোর প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য বাৎসরিক ১ম, ২য় ও ৩য় পুরষ্কার (National Productivity and Excellence Award) ঘোষণা করেন। তিনি আবার বন্ধ পাটকলগুলো চালু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু ন্যাশনালাইজড পাট কলগুলো তাদের ওয়েস্টেজ কমানোর পরিবর্তে লোকসানের অংক বাড়াতে থাকে।  যার ফলে ২৮ জুন  ২০২০ বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী পাটকল বন্ধের এই ঘোষণা দিতে বাধ্য হন।    
 
আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, ন্যাশনালাইজড ও প্রাইভেট কলকারখানায় প্রোডাক্টিভিটি বাড়িয়ে বিশ্ব রপ্তানি বাজারে আমাদের পণ্যের শক্তিশালী বাজার সৃষ্টি করবে, দেশের শিল্প কারখানার বিকাশ লাভ করবে। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী নামের অসাধু পাটকল মালিক টাকা পাচার করে বা সরিয়ে নিয়ে আর কতিপয় অসৎ সরকারি কর্মকর্তা আর কর্মচারীর লাগামহীন দুর্নীতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি সুন্দর স্বপ্নের মৃত্যু ঘটিয়ে ছাড়লো।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭