ইনসাইড থট

করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের দায় ও নিউ নরমাল নৈতিকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 29/06/2020


Thumbnail

রাষ্ট্রীয় সীমারেখা অতিক্রম করে বিশ্ব বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার লাভের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশগুলো ভুলেই গিয়েছিলো তাদের আপন সত্তা। বিশ্বমানব হওয়ার চেষ্টা করছিলো বিশ্ব নৈতিকতা ও সম্পর্কের নিরিখে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল পোশাক শিল্পের বিশ্ব কারখানা।  এখানে সস্তায় শ্রমিক , পানি , ভূমি , বিদ্যুৎ , টেলিফোন, নিরাপত্তা কর্মী, খাদ্য এবং আবাসনের সরবরাহ থাকতে বিদেশ থেকে প্রচুর নাগরিক বাংলাদেশে আসছিলো।  আর এখান থেকে বিশ্ব বাজারে নানা পণ্য- পোশাক, ঔষধ, সফটওয়্যার, খাদ্য সামগ্রী রফতানি হয়ে যাচ্ছে।  প্রতিদিন বন্দরে দেশি বিদেশী মানুষের আনাগোনা।  আর এসবের সঙ্গে আছে প্রবাসী শ্রমিক।  ব্যস্ততা, ধাতব শব্দ আর দূষিত বাতাসে নিঃস্বাস নেয়া ছিল দুঃস্কর।  রাস্তায় নামলে নতুন নতুন কার, দেয়ালে, দেয়ালে এয়ার কন্ডিশনার, থাই গ্লাসের চাকচিক্য ভেদ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার আনন্দে আমরা  আত্মহারা ছিলাম।  আমরা যে আমাদের রক্তার্জিত স্বাধীনতাকে দিন দিন বোতলে ভরে বিক্রি করছিলাম সেটা বুঝতেই পারছিলাম না।  নব্য কলোনি হয়ে উঠছিলো যেন আমার প্রিয় মাতৃভূমি !

কোরনা ভাইরাস তোমাকে ধন্যবাদ।  তুমি আমাদের এই নেশার জগৎ থেকে  জাগিয়ে তুলেছো।  উন্নয়নের নতুন সংজ্ঞা এখন কলোনিয়াল চিন্তার নায়কেরা নির্মাণের চেষ্টা করছেন- যেটা সহজে এই দুর্যোগের ফাঁদে উন্নয়নের তকমা হিসেবে গেলানো যায়।

বাণিজ্যিক গ্লোবালাইজেশান সুযোগ করে দিয়েছে বায়িং হাউসের মাধ্যমে বিদেশী সংষ্কৃতির বিকাশে।  তারা কেবল আমাদের বাণিজ্যনীতিকে বিনির্মানে ভূমিকা রাখে না-তারা আমাদের রাজনীতি, সামাজিক ও নীতি নৈতিকতাকে পুন:গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করবার জন্য নানা প্যাকেজ প্রোগ্রাম তাদের থাকে।  যেমন বিভিন্ন বৃত্তি সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য।  এগুলো মেধাবীদের ধরা ও শান্ত রাখবার টোপ।

যেমন রোডস ছিলেন ইম্পেরিয়ালিজমে বিশ্বাসী একজন মাইনিং ম্যাগনেট-যিনি ১৯০২ সালে একটি বৃত্তি চালু করেন কলোনিয়াল চিন্তাকে স্থায়ী রূপ প্রদানে অতি সূক্ষ কৌশলে। আমরা আধুনিকতার নামে একসময় অনেক কিছু আত্মস্থ করেছি-এখন সেখানে এসেছে টেকসই উন্নয়ন। 

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার প্রাক্কালে ঐতিহাসিক অন্যায়ের ও পাওনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিকদের। আজ কি উচিত নয় - যে ক্ষতি আমাদের হয়ে গেলো তার কিছুটা দায়ভার আমাদের উন্নয়নের ও বাণিজ্যের বন্ধুদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া?

কদিন আগে দেখলাম আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৪০ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীকে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সুবিধা দেয়ার কথা ভাবছে। শিক্ষার জন্য বিল গেটস সফটওয়্যার বিনামূল্যে দিচ্ছেন - আমাদের উন্নয়নের বন্ধুরা কি আমাদেরকে গার্মেন্টেস এর মূল্যে ল্যাপটপ দেবেন ? সেরকম প্ৰত্যাশা কি অন্যায়? তাদের কি কোনো নৈতিক দায় নেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস মহামারীতে? তারা কি বলবে - আমরাতো তোমাদের শ্রমিকদের বেতন দিয়েছি , তোমাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য দিয়েছি - আমাদের কি দায় তোমাদের স্বাস্থ্য, তোমাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখায় ?   

কোভিড-১৯ এর নতুন উৎপত্তি স্থল জানা গেছে  স্পেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নাকি এর প্রাদূর্ভাব স্পেনে দেখা গেছে। চাইনিজরা দাবি করে কোন মার্কিন সৈনিক নাকি এটা চীনে রেখে গেছে।  আর মার্কিনিরা মনে করে এটা চীন থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। 

পত্রিকার পাতা খুললে দেখা যাবে চীন আমাদের বন্ধু থাকে চায়।  আমাদের আধুনিক সমাজ বলেছিলেন গার্মেন্টস না খুললে নাকি অর্ডার বন্দ হয়ে যাবে।  আজ সারা বাংলার শরীরে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে গেলো সেটা সারাতে আমাদের উন্নয়নের বন্ধুরা কি করবেন জানতে মন চায়।

আমি দুটি চিঠি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছি। জানি তিনি কিছু করবেন না।  কারণ তিনি বিদেশী ছাত্র -নাগরিকদেরকে দেশ ছাড়তে বলেছিলেন।  তবুও বলেছি যাতে বলতে না পারেন - আপনারাতো কিছু চান নি।  কোনো উত্তর অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও আজ পাই নি।  হয়তো খবর পেয়েছেন আমরা "ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার"আন্দোলনে ছিলাম !

আমি এই কোভিড মহামারী কালীন সময়ে অনেক বিদেশী বন্ধুকেও  বলেছি।  কিন্তু কারো কোনো উত্তর পাইনি। কথায় আছে সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয় -।দুঃসময়ে সময় চীন আমাদের বন্ধু হতে চেয়েছে- সেটা খুবই ভালো সংবাদ।  আমরা আরো জেনেছি আমাদের অনেক পণ্য চীনারা বিনা ট্যাক্সে নেবে। 

আজ একটি সংবাদ দেখলাম সেটা হলো - পাটকল গুলোতে নাকি গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেয়া হবে।  আমার এখানে একটি আপত্তি ও বিকল্প ভাবনা আছে।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একসময় এই পাটকল গুলোর জন্য সংগ্রাম করেছেন।  তিনি এগুলোকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন।  আজ যখন  লাখ লাখ  লোক বেকার হতে চলেছে তখন তখন এই পাটকল শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেয়া কি সমর্থন করতে পারি ? এখানে আমাদের উন্নয়নের বন্ধুদের কি কিছু করণীয় নেই ?

আমরা  কি একটি দাবি বিশ্ব মানবতার কাছে রাখতে পারি কি না ? বিগত ৫০ বছর আমরা আমাদের বন্ধুদের অর্থনীতিতে যে অবদান রেখেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই - চীন , ভারত , যুক্তরাষ্ট্র , ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন , অস্ট্রেলিয়া , নিউজিলান্ড সকলের দায় আছে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবার।  পাটকলগুলোকে  প্রাইভেট মালিকের হাতে তুলে না দিয়ে কিভাবে এটি উৎপাদনে রেখে , শ্রমিকদেরকে কাজে রেখে কিভাবে নতুন কিছু যুক্ত করলে ওই জায়গাটি মানুষের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে সেজন্য ভাবা হোক।  কোভিড -১৯ উত্তর নৈতিকতা উন্নয়নকে এভাবে সাজাতে বলে। 

আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভেবে দেখবেন। পাকিস্তান আমলে পাটকল গুলো ব্যক্তি মালিকানায় ছিল।  বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্র মালিকানায়।  বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পরিপন্থী কাজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করতে পারেন বলে আমরা বিশ্বাস হয় না।  আর ব্যক্তি যাকে লাভজনক করতে পারে, রাষ্ট্র তাকে চালাতে পারে না ভাবা যায় না।  আজ পাটজাত পণ্য পরিবেশ বান্ধব।  সুতরাং , যারা আমাদের উন্নয়নের বন্ধু তারা যাতে আমাদের পাটকল চালু রাখতে পাশে থাকে সেটা যেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুগ্রহ করে বন্ধু রাষ্ট্রনেতাদেরকে বলেন।  এটাই নিউ নরমাল নৈতিকতা।

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ , দর্শন বিভাগ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭