ইনসাইড থট

ড. ইউনুস, করোনাভাইরাস ও আতর ব্যবসা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 05/07/2020


Thumbnail

ড. মুহাম্মদ ইউনুস গত শুক্রবার ‘গ্লোবাল ফার্মাসিউটিক্যালস সোশ্যাল বিজনেসের’ পার্টনার খোঁজার কথা জানান দ্য গার্ডিয়ানকে। অন্যদিকে আরব নিউজকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে শনিবার ড. ইউনুস এ বিষয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা জানান। আরব নিউজ জানায়, ভ্যাকসিন গবেষণায় বিশাল বিনিয়োগ এবং বেসরকারিখাতে অনেক ল্যাবরেটরির দরকার হয়। করোনাভাইরাসের টিকা যাতে উন্মুক্ত করা যায়, যাতে টিকা বিনামূল্যে দেওয়া যায়। তার জন্য অংশীদার খুঁজছেন তিনি। সে জন্য ড. ইউনুস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন।

দ্যা গার্ডিয়ান জানায়, মালিকানামুক্ত টিকার জন্য ড. ইউনুস ইতিমধ্যে একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছেন। সেখানে গোটা বিশ্ব থেকে শতাধিক নামকরা ব্যক্তি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এতে আশাবাদী ড. ইউনুস। তিনি জানান, এই আবেদনে সামিল হওয়া নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন তাওয়াক্কল কামরান, শিরিন এবাদি, মিখাইল গরবাচেভ, মালালা ইউসুফজাই, আর্চ বিশপ ডেসমণ্ড টুটু। সাবেক সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গরডন ব্রাউন, ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রদি, নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক, মরিশাসের সাবেক রাষ্ট্রপতি আমিনাহ গুরিব-ফাকিম এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজ। গত শুক্রবার পর্যন্ত এমন মোট ১১২ জন বিখ্যাত ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।

১৯৭০ দশকের গোঁড়ার দিকে ব্রিটেনে সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ বা সামাজিক ব্যবসার ধারনার সূত্রপাত হয়। পরে বাংলাদেশের ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস নোবেল বিজয়ের পরে ১৯৯০ দশকে এটাকে সোশ্যাল বিজনেস বা সামজিক ব্যবসা নামকরণ করে সারা দুনিয়ায় বিভিন্ন ভাবে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।   

কিছুদিন আগে ড. ইউনুস বিবিসিকে বলেছিলেন যে, সামাজিক ব্যবসা অন্য আর দশটি ব্যবসার মতোই হবে, তবে পার্থক্য হলো-

১. এতে বিনিয়োগকারীরা কোন লাভ নিতে পারবেন না। কেবল তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ ফেরত পাবেন। ২. সামাজিক ব্যবসার সাফল্য বিচার করা হবে সামাজিক উন্নয়নের সূচক দিয়ে। যেমন তারা কতজনকে পুষ্টি সরবরাহ করতে পারলো বা কতজনকে দারিদ্রমুক্ত করতে পারলো অথবা কতজনকে বিশুদ্ধ পানি দিতে পারলো ইত্যাদি। ৩. এই ব্যবসাতে যারা বিনিয়োগ করবেন তারা আত্মতৃপ্তি পাবেন, কোন ভালো কাজ করছেন এটা ভেবে। ৪. যারা এই ব্যবসাতে বিনিয়োগ করলেন তারা এটির মালিক থাকবেন কিন্তু লাভ নিতে পারবেন না। তবে ব্যবসার পরিচালনার সিদ্ধান্ত তারাই নেবেন এবং এতে যারা চাকুরী করবেন তারা বাজার দরে বেতন ভাতা ও সুবিধাদি পাবেন। ৫. সামাজিক ব্যবসা চাইলে মালিকেরা কিছুদিন পরে স্বাভাবিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করতে পারবেন। অর্থাৎ তারা লাভ নিতে পারবেন, যদি চান। এটা তাদের মর্জির উপর নির্ভরশীল।  

ড. ইউনুসের বক্তব্য সামাজিক ব্যবসার ৭টি মূলনীতির সাথে আংশিক মেলে। সামাজিক ব্যবসার মূল কথা হচ্ছে যে সমাজে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে, সেই ব্যবসার মাধ্যমে ঐ সমাজের মানুষের কর্মী নিয়োগ করে তাঁদের জীবন মানের ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন করা। ড. ইউনুস নিজের ইচ্ছা মত নতুন করে সামাজিক ব্যবসার সংজ্ঞা তৈরি করছেন। কিন্তু বাস্তবে কী হয় আসুন কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করি। কোন দেশের কোন এলাকায় যে সম্পদ অব্যবহৃত থাকে যা মূল্যবান তার ব্যবহার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই সেখানে কোন সামাজিক ব্যবসা শুরু করা হয়। সাধারণত কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি (সিএসআর) ফান্ড ব্যবহার করে ছোট, বড় মাঝারী বিদেশী কোম্পানি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে এই ব্যবসা শুরু করে।

সামাজিক ব্যবসার কোম্পানি গঠনের সাথে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে একজন বলেন যে, সাধারণত: সামাজিক ব্যবসার জন্য বাংলাদেশে লিমিটেড কোম্পানি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এতে সাধারণত পরিচালক থাকেন ৬ থেকে ১০ জন। বিনিয়োগকারী কোম্পানি আর এদেশীয় ‘বড় মানুষের’ প্রতিনিধি আধা আধি ভাগ করে নেন পরিচালকের সংখ্যা, যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানির বিনিয়োগ ৯৫ থেকে ৯৯% আর যে দেশে কোম্পানি হবে তাঁদের মানে ‘নামী দামী মানুষদের’ বিনিয়োগ ১% থেকে ৫%, কোন কোন ক্ষেত্রে একটু বেশী। কিন্তু পরিচালকের সংখ্যা সমান সমান। ব্যবসার মুনাফা থেকে কর্মচারীর বেতন ভাতা বাদে মুনাফার একটা বড় অংশ খরচ হয় পরিচালকদের রেমুনারেশন বা ভাতা হিসেবে, যা আয়কর মুক্ত থাকে। সেখানে দেশী পরিচালকগন বিদেশি পরিচালকের প্রায় সমান ভাতা পান, যদিও বিনিয়োগ শূন্য প্রায়। যিনি বিদেশী কোম্পানিকে ম্যানেজ করে নিয়ে আসেন তিনি তো পরিচালক হবেনই, সেটা মাস্ট। কোম্পানির সভায় যোগদানের জন্য বিদেশ থেকে পরিচালকদের আসা যাওয়ার সমস্ত খরচ বহন করা হয় কোম্পানির মুনাফা থেকে। বাংলাদেশে ড. ইউনুস যে কয়টি সামাজিক ব্যবসার কোম্পানি চালাচ্ছেন তার প্রতিটিতেই তিনি নিজে আর তাঁর একান্ত বিশের অনুগত দেশি বিদেশে অবস্থানরত বাঙ্গালি যারা বিভিন্ন কোম্পানিকে এই ব্যবসায় রাজি করান তাঁরা বিন পুঁজিতে পরিচালক হয়ে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছেন এমন নজির বাংলাদেশে অনেক আছে।        

ড. ইউনুসের বর্তমান উদ্যোগে করোনাভাইরাসের টিকা বিনামূল্যে সবাইকে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের সমস্ত খরচ আসবে বিভিন্ন দেশের বড়, মাঝারী কোম্পানির সিএসআর ফাণ্ড থেকে। সেই টাকায় তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা যেহেতু বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে তাই এখানে লাভ করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু যারা এই সামাজিক ব্যবসার কোম্পানি গঠনে টাকা দেবেন তাঁরা এক বা একাধিক কোম্পানি গঠন করবেন, যার প্রতিটিতেই পরিচালক হিসেবে থাকবেন ড. ইউনুস ও তাঁর বিশেষ অনুগত তথাকথিত কিছু শিক্ষিত মানুষ। এর বাইরেও কিছু লোক নিয়োগ করা হবে টিকা বিতরণ দেখভাল করার জন্য যাতে ড. ইউনুসের সুপারিশের বিশেষ প্রাধান্য থাকবে। আর থাকবে প্রথম শ্রেণীতে বিমানে সারা দুনিয়া ঘোরা, দামি হোটেলের সুইট রুমে থাকা, মোটা অংকের টিএ- ডিএ, এলাউন্স নেওয়া, পরিচালক হিসেবে বিদেশী পরিচালকের সমান মোটা অংকের  রেমুনারেশন বা ভাতা নেওয়া, ইত্যাদি। ড. ইউনুসের সামাজিক ব্যবসার কোম্পানি গঠনের অতীত ইতিহাস এমন প্রমাণই বহন করে। তাই করোনাভাইরাসের টিকা বিনামূল্যে দেওয়ার ড. ইউনুসদের ধান্দাটা সফল হলে আগামী ৪/৫ বছর তাঁদের দিনকাল মন্দ যাবে না।        

ড. ইউনুসের বর্তমান আচরণ নিয়ে সাবেক সচিব ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসনাত আব্দুল হাই সাহেবের একটা সত্য ঘটনার বর্ণনার কথা মনে পড়ে যায়। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকের কথা। তখন নোয়াখালীর একটি বিশেষ এলাকার বয়স্ক মানুষ রোজার সময় দলে দলে সারা দেশে আঁতর বেঁচেতে যেতেন। আঁতর ব্যবসায় তখন লাভ ছিল খুব বেশি। একদিন একজন আঁতর বিক্রেতা আঁতর বেঁচে মাঠের আল পথ দিয়ে গ্রামে ফিরছেন। মাঝ মাঠে তাঁর এক গরীর কৃষক আত্মীয়ের সাথে দেখা কুশল বিনিমিয়, কেমন ব্যবসা হল ইত্যাদি কথা হয় স্থানীয় ভাষায়। গরীব কৃষক দাবি করে বসেন তাঁকে কেনা দামে একটা ভালো সুগন্ধি দিতে। অনেক বেছে বেছে গরীর কৃষক আঁতর বিক্রেতার কাছে আসল মৃগনাভির সুগন্ধির দাম জানতে চাইলেন। আতরওয়ালা বললেন, এটা তিনি বাইরে ৫ টাকা শিশি বিক্রি করেন, তবে আত্মীয় হিসেবে আর মৌসুমের শেষ ব্যবসা কেনা দাম ১ টাকায় সে তাঁকে দিতে পারবে।  কৃষক তাতেই রাজি। আতরের শিশি নিয়ে কৃষক একটা আধুলি ফেলে দিয়ে দিল আল পথে দৌড়। আঁতরওয়ালা ডাকে “এই শুনে যা, তুই এক টাকা না, আধুলি দিয়েছিস। চাষি বলে জানি, আর দেবো না। ওটাই রাখ। আঁতর বিক্রেতা হাসতে হাসতে কৃষককে ডেকে বলেন, দাঁড়িয়ে কথাটা শুনে যা, তোরে কিছু বলবো না। তুই মনে করছিস, আমাকে ঠকিয়েছিস, আসলে তা না, এখানেও আমি এক সিকি লাভ করেছি। লাভ ছাড়া আমি এক পাও ফেলি না“। আর্থিক লাভ ছাড়া এক পাও না ফেলা মানুষ এই বাংলায় যুগে যুগেই আছে, হয়তো থাকবে আরও কিছু দিন।                  

     



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭