ইনসাইড বাংলাদেশ

মানবতার সঙ্কটের ৪ মাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 07/07/2020


Thumbnail

করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া একজন হিন্দু ব্যবসায়ীর মুখাগ্নি করছেন এক মুসলিম কাউন্সিলর। ঘটনাটি ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে। মানবিক এ ঘটনার পেছনে রয়েছে এক বা একাধিক অমানবিক ঘটনাও, যা আমাদের বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। কী ঘটেছিল সেখানে?

ওই ব্যবসায়ী ও তার ছয় বন্ধু কাছাকাছি থাকবেন তাই সবাই মিলে তৈরি করে নিয়েছেন সাততলা একটি ভবন। ওই ভবনের চতুর্থতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। ছয় বন্ধুর সঙ্গে সখ্যও ছিল খুব। কিন্তু করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর থেকে সবকিছু বদলে যেতে থাকে। তার বা পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়নি সেই বন্ধুরা। নিজেকে রক্ষার সীমাহীন দুশ্চিন্তা তাদের অন্ধ করে দেয়। ওই ব্যবসায়ীকে তার স্ত্রী আর দুই মেয়ে মিলে হাসপাতালে নেওয়ারও চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনতলার সিঁড়ি পর্যন্ত নিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। একটু পানি খেতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে সে পানিটুকু নিয়েও এগিয়ে আসেননি কেউ। তার লাশ কয়েক ঘণ্টা পড়েছিল সিঁড়িতেই।

খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার। তার নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবী ওই ব্যবসায়ীর শেষকৃত্য করার প্রস্তুতি নেয় কেন্দ্রীয় শ্মশানে। কিন্তু সেখানেও উপস্থিত হননি মৃতের আত্মীয়স্বজনরা কেউ। ফলে স্ত্রীর অনুমতিতে সরকারি পুরোহিতের সহায়তায় শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন কাউন্সিলর।

আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। এমনটাই প্রচার চালাচ্ছে সরকার। তবু মানুষের ভেতর আতঙ্ক কমছে না। করোনা শনাক্ত হলেই ওই ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতি নির্দয় হয়ে উঠছেন আশপাশের মানুষ। সংক্রমিত কারুর মৃত্যু হলে ওই পরিবার হয়ে পড়ে আরও অসহায়। তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়েও আসেন না। যে মানুষটি প্রিয়জনদের বিপদে নানাভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মানুষটি করোনায় আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে অবহেলার পাত্র হয়ে দাঁড়ান। সবাই মুখ ফিরিয়ে নেন। তার পরিবার নিদারুণ এক কষ্টের মুখে পড়ে। যারা এই আচরণগুলো করছেন তারা কি নিশ্চিত তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না? করোনার সংক্রমণ থেকে যদি বেঁচেও যান কিন্তু মনের ভেতরের এমন নির্দয়তা ও নির্মমতার ভাইরাস থেকে তারা মুক্ত হবেন কীভাবে?

নিশ্চয়ই মনে আছে, কিছুদিন আগে করোনায় আক্রান্ত ধারণায় অসুস্থ মাকে তার ছেলেরা শফিপুরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল! প্রশাসনের লোকজন তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এবং সেই মায়ের করোনা টেস্ট নেগেটিভ এসেছিল।

করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে আরেক প্রতিবন্ধী মহিলাকে পরিবারের সদস্যরা আইসোলেশনের নামে খেতের ঝুপড়িতে অনাহারে রেখেছিল।

 

এই দুঃসময়ে কিছু বাড়িওয়ালা স্বাস্থ্যকর্মী ভাড়াটিয়াদের বাসায় ঢুকতে দিতে চাইছেন না বা নোটিশ দিয়ে দিচ্ছেন। কিছু প্রতিবেশী করছে অমানবিক আচরণ, অত্যাচার, ঘৃণা। এই তো সেদিন এক স্বাস্থ্যকর্মীর বাসায় সারা রাত ঢিল ছুড়ে পরিবারসহ তাঁকে এলাকা ছাড়ানোর চেস্টা করেছিল।

ইদানীং হাসপাতালে বাবার লাশ রেখে ছেলেরা পালিয়ে যাচ্ছে। রাতের গভীরে নাম–পরিচয়হীন লাশ রাস্তায় পড়ে থাকছে। জানাজায় বা দাফনে আপনজন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। খবরের বাইরে আছে এমন বহু খবর।

তাহলে কি এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে করোনা মহামারি আমাদের অমানবিক করে তুলছে? অথবা আমরা আসলেই অমানবিক জাতি!

অবশ্যই না, কক্ষনো না!

যারা এ আচরণ করছে, তাদেরও আছে স্বপক্ষ যুক্তি। তারা নিজের ও পরিবারের সুরক্ষায় শঙ্কিত হয়েই এসব করেছে। এই ঘটনাগুলোর পেছনে কাজ করেছে অতি সচেতনতা বা অসচেতনতা। আর এর জন্য দায়ী অজ্ঞানতা।

কত মহামারি গেছে, যুদ্ধ গেছে এ দেশে। সবাই সবাইকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছে, মরেছে। এই আমরা আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশীর মৃত্যু বা অসুখের খবর শুনলেই ছুটে যাই। হাসপাতালে স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। লাশবাহী গাড়ি, জানাজার মাঠে জায়গা পাওয়া যায় না। কেননা আমরা হচ্ছি সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, বিরহে ‘মরি বাঁচি একসাথে’- এই মন্ত্রব্রতে দীক্ষিত জাতি।

কিন্তু সম্প্রতি সামাজিক দূরত্বের নামে যে অমানবিকতা হচ্ছে, এর পেছনে উতকণ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে অজ্ঞানতা। জানতে হবে, সর্দি–কাশি মানেই করোনা রোগ নয়। আর তা যদি হয়েই থাকে, তবে তার উপসর্গ অনুযায়ী ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে আইসোলেশন বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

করোনায় আক্রান্ত ও তার পরিবারের প্রতি অমানবিক ও নির্মম আচরণের কারণেই এখন অনেকেই ভয়ে আক্রান্তের খবর গোপন রাখার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি শেরপুরের নকলায় করোনায় আক্রান্ত এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর চিকিৎসা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেলে কর্মরত ২৭ জন চিকিৎসক, ১৩ জন নার্স ও ৩২ জন স্টাফ। বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে কর্মরতদের আক্রান্তের সংখ্যাও। এভাবে রোগীর তথ্য গোপনের চেষ্টা চলতে থাকলে বড় রকমের বিপদের মুখে পড়তে হবে। তাই এ বিষয়ে সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতার বিশেষ প্রয়োজন। করোনা আক্রান্তরা যেন স্ব-উদ্যোগে তা প্রকাশ করতে পারেনসেই সামাজিক পরিবেশটা তৈরি করতে হবে। এ কাজটি করতে হবে সবাই মিলে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭