নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 11/07/2020
আমার বোন সাহারা আপাকে (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন) অকালে হারালাম। স্বাভাবিকভাবেই অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, সাহারা আপা পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন, যাদের পরিণত বয়স বলতে আসলে কোনো কিছু বোঝায় না। তাদের আল্লাহ যতদিনই পৃথিবীতে রাখেন তারা জনগণের জন্যে সবসময়ই কিছু না কিছু করে যান। ঠিক এ ধরনের মানুষ ছিলেন সাহারা আপা। প্রায় ৪০ বছর তার সাথে আমার পরিচয়। কিন্তু বেশ কিছুটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে যখন ৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে বিএনপির কাছে হেরে যায় তখন। এরপরে ওয়ান ইলেভেনের সময় আমাদের সম্পর্কটা একেবারে ভাই-বোনের মতো হয়ে যায়।
এটা ইতিহাসের অংশ যে, ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে যখন অ্যারেস্ট করতে আসে, তখন তিনি প্রথম ফোনটি করেন সাহারা খাতুনকে। সাহারা আপা তখন ধানমণ্ডি ৫ নম্বর থেকে শুরু করে কোর্ট পর্যন্ত প্রায় নেত্রীর পাশে পাশে গিয়েই হাজির হন। সেখানে গিয়েই তিনি ওকালত নামায় স্বাক্ষর করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য সাহারা খাতুনের লড়াইটা একটা ইতিহাস। এর বাইরেও অনেক ইতিহাস আছে, যা নিয়ে একটা বই লেখা চলে। আমি অল্প কিছু ঘটনা বলছি।
এক এগারোর সময় সাহারা আপা প্রায় প্রতি দিনই আমার চেম্বারে আসতেন। তার আসার কারণটা আমি বুঝতাম। তখন মন খুলে কথা বলার মতো লোক পেতেন না সেজন্য তিনি আমাকে নিজের ভাই ভেবেই আমার চেম্বারে আসতেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ সমস্ত কথা বার্তা রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই হতো।
একদিন হঠাৎ করে সাহারা আপা বললেন, ‘মোদাচ্ছের, কামরুলের (অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম) প্রতি আর্মিরা খুব ক্ষেপে গেছে। আমি একদম নিশ্চিত খবর পেয়েছি, তারা সুযোগ পেলে তাকে মোটামুটি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’ আমি বললাম, ‘কামরুলের প্রতি এত বেশি রাগ কেন?’
তিনি বললেন, ‘রাগ তো অনেক কারণেই আছে আমাদের সবার প্রতি। তার প্রতি অতিরিক্ত রাগ বোধ হয় দুটি কারণে। একটি হচ্ছে যে, সে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগী হিসেবে অনেক কাজ করছে। আরেকটি হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের যে নির্বাচন এই নির্বাচনে শফিক সাহেব (ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ) যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন, সেজন্য তাকে চাপ দিতে কামরুলকে কিছু করা হতে পারে। তাদের ধারণা, যেভাবেই হোক কামরুলকে যদি হুমকি ধমকি দেওয়া যায়, তাহলে কামরুল কোনো রকমভাবে নেত্রীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসে শফিক সাহেবকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নিতে পারবেন।’ শফিক সাহেব নীতিবান এবং দৃঢ় একজন আইনজীবী। তিনি ওই নির্বাচনে অংশ নেন এবং জিতে যান।
আমি যেহেতু নেত্রীর চেক আপ করতে বিশেষ কারাগারে যেতাম। তাই নেত্রীর ব্যাপারে সাহারা আপার সাথে আমার অনেক কথা হতো। তিনি একবার বললেন, ‘শোনা যাচ্ছে যে, নেত্রীকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কি কোনো ব্যবস্থা বা সতর্কতা অবলম্বন করছি আমরা?’ এ রকমভাবে নেত্রীর ব্যাপারে প্রতিটি কথায় আমি লক্ষ্য করতাম, নেত্রীর জন্য তার উদ্বেগ এবং ভালোবাসা ছিলও প্রবল।
যতদিন সাহারা আপা জীবিত ছিলেন, তার ধ্যান ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রদর্শিত পথে চলা। সমস্ত লোভ লালসার উর্ধ্বে তিনি ছিলেন। তিনি এমপি, নাকি মন্ত্রী, নাকি প্রেসিডিয়ামের সদস্য, এসব কোনো ক্ষেত্রেই তার ভিতরে কোনো পার্থক্য দেখিনি। তিনি কোন পদে আছেন নাকি নাই, কখনও তার আচার ব্যবহারে বিন্দুমাত্র পার্থক্য দেখিনি। ফোন করলে সবসময় রিসিভ করেছেন। সবসময় আমার মনে হতো আমি আমার নিজের বোনের সঙ্গে কথা বলছি।
কিছুদিন আগে আমি আমার একটা ভাইকে হারালাম। তিনি হচ্ছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বয়সে সে আমার কিছুটা ছোট ছিল। সাহারা আপার সাথে আমি যেমন নিজের বোনের মতো কথা বলতাম, নাসিমের সাথেও আমার তেমনি ছোট ভাইয়ের মতো আলাপ-আলোচনা হতো। নাসিমের মৃত্যুর পর আমাকে অনেক মিডিয়া থেকে বলা হয়েছিল, তার স্মৃতিচারণ করে কিছু বলার জন্য। কিন্তু আমি পারিনি। আমি তাদের শুধু এতটুকুই বলতে পেরেছিলাম যে, আমি কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। সেই আঘাতটা কাটিয়ে ওঠার আগেই আমার বোন সাহারা আপাও চলে গেলেন।
আমার মনে হচ্ছে, যারাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বার্থের উপরে উঠে ভালোবাসেন, শেখ হাসিনা ছাড়া যাদের দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ কোনো ঠিকানা নেই, যাদের একমাত্র ঠিকানা শেখ হাসিনা- সেই মানুষগুলো একের পর এক চলে যাচ্ছেন। এই মৃত্যুগুলো আমাদের অনেককেই শোকস্তব্ধ করে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ব্যাথাটা অনুভব করছেন, আমাদের কষ্টের সঙ্গে বোধ হয় সেটার তুলনা চলে না। কেননা কয়েক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী তাদের চেনেন, জানেন এবং এদের সুখ দুঃখে সবসময় সবচেয়ে কাছের মানুষটি হয়ে পাশে থেকেছেন।
আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যারা জননেত্রীর জন্যে সব সময় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে তার সাথে থাকছেন, তাদের যেন আল্লাহ তুলনামূলকভাবে একটু বেশি আয়ু দান করেন। যাতে তারা বেশিদিন পর্যন্ত জননেত্রীর পাশে থাকতে পারেন। কারণ এখন এদেশের প্রায় ১৭ কোটি লোকের শেষ ঠিকানা হচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। যদি এখন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কাছের লোকরা না থাকেন, তাহলে তো তিনি মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন। সেই কারণে আজ শুধুমাত্র সাহারা আপার কথাই স্মরণ করছি না, যারা জননেত্রীর জন্য ভাবেন, কাজ করেন- তাদের সকলের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছি। আল্লাহ যেন তাদেরকে দীর্ঘায়ু দান করেন।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭