ইনসাইড থট

তথ্যমন্ত্রীর জন্য তিন উল্লাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 31/07/2020


Thumbnail

একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলো। তাঁরা এই পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হলে তাঁদের ক্যারিয়ার উজ্জ্বল হবে এবং তাঁরা নতুন যাত্রা শুরু করতে পারবে। পরীক্ষা গ্রহণ করেছে যে কর্তৃপক্ষ তাঁরা খাতা দেখার দায়িত্ব দিলেন পরীক্ষকদের। পরীক্ষকরা নানা কাজে ব্যস্ত এবং তাঁরা দেড় বছর সময় ধরে দুইশ শিক্ষার্থীর পরীক্ষাপত্র দেখতে সক্ষম হলো। এই দুইশ জনের মধ্যে দেখা গেল ৩৪ জন উর্ত্তীর্ণ হয়েছে। বাকি খাতাগুলো দেখা হলো না। এখন কর্তৃপক্ষ এক সিদ্ধান্ত নিল যে সমস্ত পরীক্ষার্থীর খাতা দেখা হয়েছে, সেই সমস্ত পরীক্ষার্থীর মধ্যে যারা উর্ত্তীর্ণ হয়েছে তাঁদের নাম প্রকাশ করে দেওয়া হোক যে তাঁরা উর্ত্তীর্ণ- এই মর্মে সার্টিফিকেট দেওয়া হোক। আর বাকি যাদের খাতা এখনো পরীক্ষকরা দেখে শেষ করতে পারেননি, যখন তাঁদের খাতা দেখা শেষ হবে তখন তাঁদের যে ফলাফল হবে সেই ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হবে।

পাঠক, ভাবছেন এটা কি কোন উদ্ভট সিদ্ধান্ত? এক পরীক্ষার কয়বার ফলাফল দেওয়া যায়? এক পরীক্ষার ফলাফল কি ভাগ ভাগ করে দেওয়া যায়? আপনি যতই উদ্ভট ভাবুন না কেন আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয় এই কাজটিই করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে অনলাইন নিয়ে বিষদাগার করেছেন, তারপর তিনি বলেছেন অনলাইনকে নিবন্ধিত করতে হবে। এই নিবন্ধনের জন্যে তিনি আবেদন আহ্বান করেছেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে সাড়ে তিন হাজার অনলাইন পোর্টাল।

এটা যেমন অস্বীকারের উপায় নেই যে বাংলাদেশে এখন ব্যাঙের ছাতার মতো অনলাইন পোর্টাল বেড়ে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে অনলাইন পোর্টাল হচ্ছে। আবার এটাও অস্বীকারের উপায় নেই যে, গণমাধ্যমের এই ধারাটি বাংলাদেশে এখন প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া। মানুষ এখন অনলাইনের উপর নির্ভরশীল। আর অনলাইন নির্ভরশীল এই মানুষগুলো যেন সঠিক তথ্য পায় সেটা নিশ্চিতের জন্যেই একটি নিয়ম, কানুন, শৃঙ্খলা দরকার ছিল, আর একারণেই অনলাইন নিবন্ধন একটি জরুরী প্রক্রিয়া ছিল। গত বছরের জুন মাসে এই আবেদন গ্রহণের প্রক্রিয়া শেষ হয়। এরপর তথ্য মন্ত্রী বহুবার বলেছেন যে, এই নিবন্ধনের কাজ চলছে। গতকাল ৩৪ টি অনলাইনের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো যে অনলাইনগুলোকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে (কারো উপর কটাক্ষ না করেই বলা যায়) এর একটি বড় অংশ এখন আলোর মুখ দেখেনা, ক্ষীণ আকারে প্রকাশিত হয়, একটি অনলাইন পোর্টাল থাকতে হয় তাই থাকে। পেশাদারিত্বের সাংবাদিকতার নাম-নিশানাও অধিকাংশ এই নিবন্ধিত অনলাইনগুলোর নেই। অথচ এর বিপরীতে যে অনলাইনগুলো পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে, প্রতিনিয়ত মূলধারার সংবাদপত্রের সঙ্গে লড়াই করে যারা নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে এরকম অনলাইন পোর্টালগুলো প্রথম দফায় নিবন্ধনের তালিকায় নেই।

আমরা অন্য কথা না বলে বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সূচনা হয়েছিল বিডিনিউজের হাত ধরে। বিডিনিউজ, বাংলানিউজ-এর কোনটাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকার মধ্যে নেই। এটা চরম বিষ্ময়কর একটি ঘটনা। আর এরকম বিষ্ময়কর ঘটনা ঘটিয়ে তথ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই বাহবা পেতে পারেন।

আমাদের তথ্যমন্ত্রীর প্রতিভা বহুমাত্রিক। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও দ্বিধান্বিত। এজন্যেই ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনা করছেন চারবার, তিনি মন্ত্রিসভায় যে মন্ত্রীকে যখন যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই মন্ত্রী টানা দায়িত্ব পালন করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক মেয়াদের পর মন্ত্রী বদল করে অন্য মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় বদলের ঘটনা শেখ হাসিনা খুব কমই করেছেন। উদাহরণ দেওয়া যায়, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে দিয়ে। তিনি কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তিন মেয়াদে। তোফায়েল আহমেদ দুই মেয়াদেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এদিক থেকে বিরল ব্যতিক্রম আমাদের তথ্যমন্ত্রী। তিনি প্রথমে শুরু করেছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। এরপর তাকে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয় এবং এবার তাকে দেওয়া হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। একজন মন্ত্রী দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন এমন উদাহরণ বহু আছে, কিন্তু একজন মন্ত্রী তিন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন এমন উদাহরণ বোধ হয় ড. হাছান মাহমুদই একমাত্র। এই জন্যে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেই কিছু একটা করে দেখানোর প্রয়াস করলেন।

এবার আসা যাক এই অনলাইন পোর্টালগুলো নিবন্ধিত হয়েছে কোন প্রক্রিয়ায়? তথ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, এসবি এবং এনএসআই- দুটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, বাহ কি চমৎকার! বাংলাদেশের গণমাধ্যম তাহলে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরিচালিত হবে?

একটি নিউজ পোর্টাল বা একটি সংবাদপত্র নিবন্ধন বা ছাড়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই গোয়েন্দা তদন্তের দরকার আছে এবং গোয়েন্দা তদন্ত করে দেখতে হবে যে ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কারা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কার্যক্রম করার অভিযোগ আছে কিনা, তাঁরা রাষ্ট্রের জন্যে ক্ষতিকর কিনা এবং তাঁদের আয়ের উৎস কি? অবশ্য প্রতারক সাহেদও তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পত্রিকা প্রকাশের ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। এরকম বহু দুর্বৃত্তই বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার ছাড়পত্রসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পায়। এই বাস্তবতায় গোয়েন্দা তদন্ত যে অত্যন্ত জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ তা অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ কি তাহলে? তথ্য মন্ত্রণালয় কি কেবল পোস্টবক্স?

গোয়েন্দা তদন্তের পর তথ্য মন্ত্রণালয়কে যাচাইবাছাই করে দেখতে হবে যে, যে প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধনের জন্যে আবেদন করেছে তাঁর পেশাদারিত্ব আছে কিনা, সেই প্রতিষ্ঠানটির আদৌ কোন অফিস আছে কিনা, কতজন কর্মচারী কাজ করেন, তাঁরা বেতন পান কিনা- ইত্যাদি নানা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা, সবথেকে বড় কথা হলো, সাংবাদিকতার আচরণ-বিধি-নিয়মগুলো অনুসরণ করে ঐ অনলাইন পোর্টালটি পরিচালিত হচ্ছে কিনা। তথ্য মন্ত্রণালয় এরকম কিছু দেখেছে এমন কোন নজির, এমন কোন বক্তব্য আমরা পাইনি।

সবথেকে বড় কথা হচ্ছে যে, আমাদের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর এভাবে একটি বিভ্রান্তিকর নিবন্ধন তালিকা প্রকাশ করে তথ্য মন্ত্রণালয় নিজেই বিভ্রান্তিতে পড়লো। এখন যারা নিবন্ধিত তাঁদের কি হবে, যারা অনিবন্ধিত তাঁদের কি হবে? যদিও তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে, যারা এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি তাঁদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই- তাহলে এই তালিকাই বা কেন? একসঙ্গে যখন সাড়ে তিন হাজার আবেদন সম্পন্ন হয়েছে তখন শিষ্টাচারসম্পন্ন ভদ্রচিত হতো যদি সবগুলো যাচাইবাছাই করে এই তালিকা প্রকাশ করা হতো। কিন্তু সেটা করতে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে আমাদের তথ্য মন্ত্রনালয়।

আমাদের তথ্য মন্ত্রী অনেক কথা বলেন রাজনীতির বাহাসে, তিনি অত্যন্ত পটু। কিন্তু রাজনীতির মাঠের বক্তৃতা আর মন্ত্রণালয়ের একটি নিয়ম-নীতি- শৃঙ্খলা মেনে দায়িত্ব পালন এক নয়। সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। তারপরেও তথ্যমন্ত্রী অনলাইনের নিবন্ধন দিয়েছেন, ৩৪ টি অনলাইন পোর্টাল এখন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং অনলাইন নিবন্ধনের জন্যে দীর্ঘদিন যাবত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো কথা বলছিল, তাঁরা বলছিল যে, তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তথ্যমন্ত্রী এই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। এর ফলে অনলাইন পোর্টালগুলোর লাভ হয়েছে না অনলাইন পোর্টালগুলোকে তিনি বিতর্কিত করলেন সেই বিচার পরে করা যাবে, সে বিচার করবে ইতিহাস। কিন্তু এই অনলাইন পোর্টাল নিবন্ধনের মধ্যে দিয়ে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হলো যে, বাংলাদেশে এখন সাংবাদিকতার মূলধারা অনলাইনই।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭