ইনসাইড থট

যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ এবং কোভিড-১৯

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 02/08/2020


Thumbnail

কোভিড-১৯ এর শুরু

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীন প্রথম বিশ্বকে জানায়, উহানে নতুন একটি ভাইরাসের (করোনা ভাইরাস) প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। এরপর মাত্র তিনদিনের মধ্যেই চীন ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করে ফেলে। ডিসেম্বরের ওই সময়টাতে লাখ লাখ ইউরোপীয় নববর্ষ (২০২০) উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখন ইউরোপের পাবলিক হেলথ এজেন্সি ইসিডিসি’র (ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল) স্টকহোম অফিস চীনে নিউমোনিয়ার গণ সংক্রমণের বিষয়ে জানতে পারে। নতুন এই ভাইরাস বিশাল এক হুমকি জানিয়ে ইসিডিসি প্রথম তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে ৯ জানুয়ারি। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মানুষ থেকে মানুষে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের যাতায়াতের ফলে জানুয়ারির প্রথম দিকেই এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাস্তব সম্ভাবনায় রূপ নেয়।   ২৫ জানুয়ারি কোটি কোটি চীনা তাদের বর্ষবরণের জন্য নানা প্রস্তুতি নিয়েছিল। নতুন বছরের ছুটিতে প্রায় ৩ লাখ চীনা নাগরিক যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে ভ্রমণ করবে বলে আশা করা হচ্ছিল। ইউরোপীয় দেশগুলোতে কেবল উহান থেকেই সপ্তাহে ১২টি ফ্লাইট ছিল। বড় ধরনের বিপদ উপলব্ধি করতে পেরে ১৭ জানুয়ারি ইউরোপীয় কমিশনের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠক ডাকে। ওয়েব লিংক ও টেলিফোনের মাধ্যমে ওই বৈঠকে ২৭ টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ১৭টি অংশ নিয়েছিল। যুক্তরাজ্যেরও অংশগ্রহণ সেখানে ছিল। এরপর ২৯ জানুয়ারি ইসিডিসি ইউরোপের সব দেশের সরকারকে টেস্ট, আইসোলেশন, হাসপাতাল বিশেষ করে আইসিইউ সক্ষমতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, তখন যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমগুলো মহামারির থেকে ব্রেক্সিট নাটক নিয়ে আগ্রহী ছিল বেশি। সে সময় জনসচেতনতা তৈরিতে সরকার তাদের শক্তি প্রয়োগ করেনি। মহামারি প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে রাজনৈতিক চাপও সৃষ্টি করা হয়নি। সংক্রমণ হ্রাস বা বন্ধ করার জন্য সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সংক্রামক ব্যাধি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপই তখন নেওয়া হয়নি।  জানুয়ারির শেষের দিকে চীনের মূল ভূখণ্ড এবং হংকংয়ের ডাক্তাররা কোভিড-১৯ এর ক্লিনিকাল বৈশিষ্ট্য, মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ, জিনোম বৈশিষ্ট্য, রোগীদের লক্ষণ ইত্যাদি চিহ্নিত করেছিলেন এবং বিশ্বকে একটি মহামারির হুমকির বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। জানুয়ারির শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জেনেভায় তাদের সদর দপ্তর থেকে প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে  এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে সমস্ত তথ্য সরবরাহ শুরু করেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে, করোনা প্রতিরোধের  উপায় হলো পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা। পাশাপাশি তারা বিচ্ছিন্নকরণ এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এর উপরেও জোর দিয়েছে। ডব্লিউএইচও’র বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়মিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে। ৩০ জানুয়ারি তারা করোনার প্রাদুর্ভাবকে পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এটা বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয় বলে ঘোষণা দেয়। ১১ মার্চ তারা করোনাকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে।

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এশিয়ার অনেক দেশেই রাজনীতিবিদ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একসঙ্গে কাজ করছেন। সার্স এর প্রাদুর্ভাবের সময় যারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং শিক্ষা নিয়েছিলেন, কোভিড-১৯ এর সময় তারা সংক্রমণ বন্ধ করার জন্য অনতিবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করে। ২৫ জানুয়ারি চীনা নববর্ষ উদযাপন বাতিল করা হয়। চীন জুড়ে বিমান বা যেকোনো পরিবহনে যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। উহান এবং হুবেইসহ চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য কমান্ড ফর ইপিডেমিক কন্ট্রোল (সিইসি) গঠন করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় আন্তঃপ্রদেশ বিমান, বাস এবং রেল পরিষেবাও বন্ধ রাখা হয়। ২৯ জানুয়ারির মধ্যে চীন পুরো হুবেইকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। হুয়াংগ্যান্ড, ওয়েনঝোউসহ চীনের মূল ভূখণ্ডের অন্যান্য শহরগুলোরগুলোতেও কারফিউ জারি করা হয়। গণ পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংও চলতে থাকে। চীন তখন বেশ কিছু হাসপাতাল নির্মাণের কাজও শুরু করে এবং হাসপাতালগুলোর ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হংকং, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়াও জানুয়ারির প্রথম থেকেই ব্যাপক পরীক্ষা, বিচ্ছিন্নকরন এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং শুরু করে। কিন্তু যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ইউরোপীয় রাজনৈতিক নেতারা তাদের দেশে তুলনামূলকভাবে দেরিতে করোনা সংক্রমণের সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেনি। সংক্রমণ রোধ, কোভিড-১৯ দুর্যোগ প্রতিরোধ, জনদুর্ভোগ হ্রাস, এবং মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব করেছিল তারা। 

কোভিড-১৯: যুক্তরাজ্য

বিশ্বের বহু সরকার যখন কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছিল এবং ২৯ জানুয়ারির মধ্যে যুক্তরাজ্যে প্রথম দুজন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছিল তখনও দেশটি এ বিষয়ে তেমন মনোযোগ দিচ্ছিল না। যুক্তরাজ্যের রাজনীতিবিদ এবং বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতারা খুব ধীরে কাজ করছিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানুয়ারির শেষের দিকে এবং ফেব্রুয়ারির শুরুতে টানা পাঁচটি জরুরি সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব এবং সরকারের পুরো বৈজ্ঞানিক ও চিকিত্সা পরামর্শদাতারা সংকটের মুখে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি ব্রেক্সিট ইস্যুতে এক বক্তৃতায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চীন স্টাইলের লকডাউন সম্পর্কে তার মতামত পরিষ্কার করেছিলেন। তিনি জনগণের অবাধ চলাচলের পক্ষে কথা বলেছিলেন আর লকডাউনকে উদ্ভট বিষয় বলে উল্লেখ করেছিলেন। মহামারী সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার বদলে তিনি সারা দেশে যেন কেনা-বেচা অর্থাৎ ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত থাকে সেদিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।  বিষয়ে কথা বলেছেন। এরপর খুব দ্রুতই প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব এবং ডাউন স্ট্রিটের স্টাফরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হতে থাকে। এতে প্রমাণিত হয় যে, তারা জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া তো পরের বিষয় নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও তারা যথেষ্ট পরিমাণে সচেতন ছিলেন না। হাজার হাজার ব্রিটিশ নাগরিক ইতালি ও কোভিড আক্রান্ত অন্যান্য দেশে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। ৯ মার্চ ইতালি দেশব্যাপী লকডাউন আরোপ করে। এর পরের শনিবারে স্পেনও গোটা দেশ লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাজ্য সে সময় কেবল নিজেদের পর্যটকদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে যখন ব্রিটিশ পর্যটকরা নিজ দেশ ফিরছিল তখন যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের তথ্য নিবন্ধন করেনি, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংও করতে পারেনি তারা। রাজনীতিবিদরা গণজমায়েত। পাব, রেস্তোঁরা ও স্কুল বন্ধ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটা গা ছাড়া ভাব এবং অনীহা দেখাচ্ছিলেন। লকডাউনের বিরুদ্ধে অবস্থান প্রদর্শনের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং তার সঙ্গী ৭ মার্চ টিকেনহ্যামে ইংল্যান্ড বনাম ওয়েলস রাগবি ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন। ৭৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার ওই স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী অনেকের সাথে হাতও মিলিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে বেশকিছু কোভিড-১৯ রোগী যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় শনাক্ত হয়েছিল। তারা মূলত চীন এবং ইতালি থেকে এসেছিলেন। যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯ এর বড় একটি আউটব্রেক হয় ২৬-২৭ ফেব্রুয়ারিতে। সে সময় এডিনবার্গে নাইকি স্পোর্টস কনফারেন্সে স্কটল্যান্ডের ৮ জনসহ ২৫ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। সারা বিশ্বের ৭০ জন প্রতিনিধি ওই কনফারেন্সে ছিলেন। প্রায় একই সময়ে, ব্রাইটনে কোনও প্রকার বিদেশী ভ্রমণ ছাড়াই বেশ কয়েকটি কেস শনাক্ত হয়। তখন থেকে যুক্তরাজ্যে ভাইরাসটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়। এটাই ছিল সেখানে কোভিড-১৯ এর টার্নিং পয়েন্ট।ওই সময়টাতেই স্পেনে করোনার ভাইরাস বিপর্যয় সৃষ্টি করছিল এবং মাদ্রিদ মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু ছিল। দেশটিতে যত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল তার অর্ধেকই ছিল মাদ্রিদের। তবুও, লিভারপুল এবং অ্যাটলেটিকোর মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফুটবল ম্যাচটি ১১ মার্চ লিভারপুলের অ্যানফিল্ড স্টেডিয়ামে ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়। ৬০ হাজার আসনের স্টেডিয়ামটি সেদিন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। যুক্তরাজ্যের ফুটবল ভক্তদের সাথে স্পেনের মাদ্রিদ থেকে ৩ হাজারেরও বেশি দর্শক ওই ম্যাচ মাঠে বসে দেখেছিলেন। ওই এলাকার সমস্ত হোটেল পুরোপুরি ভরা ছিল।যুক্তরাজ্য এবং স্পেনের হাজার হাজার মানুষ ম্যাচটি দেখার সময় লিভারপুল শহরের পাবগুলোতে মাতাল হয়ে চিৎকার করে গান করছিল। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও ১০-১৩ মার্চ চেল্টেনহ্যাম ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। চেলটেনহাম ফেস্টিভ্যালে ৪ দিন ধরে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রেসগ্রোয়ার অংশ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে ২০ হাজারের বেশি ছিলেন আইরিশ। এসব উৎসবে আয়োজনে এসে অনেকেই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, নয়তো আক্রান্ত করেছেন। এর ফলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল।  চেলটেনহাম ফেস্টিভালের আয়োজকরা জানিয়েছিলেন, একই সপ্তাহে বেশ কয়েকটি বড় ক্রীড়া ইভেন্ট যুক্তরাজ্য জুড়ে হয়েছিল। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব নিয়ে উদ্বেগ সত্ত্বেও ঘোড়দৌড়ের কিছু আগে আন্তর্জাতিক রাগবি ম্যাচে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং তারা তাদের ফেস্টিভ্যাল চালানোটাও তেমন কোনো বড় ভুল বলে মনে করেননি।

জনপ্রিয় একটি ব্যান্ডদলের ক্লাসিক রক পারফরমেন্স উপভোগ করতে আমি কয়েক মাস আগে টিকেট বুক করেছিলাম এবং ৮ ফেব্রুয়ারি লিভারপুলের ফিলহার্মোনিক হলে আমি তাদের পরিবেশনার সময় উপস্থিত ছিলাম।  ওই হলে ২ হাজারের বেশি আসন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল।  সমস্ত টিকিট কয়েক মাস আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল এবং তারা শো বাতিল করেনি। সেখানে একটি উত্সবের আমেজ ছিল। মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল এবং মদ্যপান করছিল।

আবার, ১৩ মার্চ আমি এবং আমার বন্ধু যিনি নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম থেকে আমাকে দেখতে এসেছিলেন, আমরা লিভারপুলে একটি নাট্য সঙ্গিতের শো উপভোগ করতে গিয়েছিলাম। ওই হলে ২ হাজার ৩০০ জনের বসার ব্যবস্থা ছিল এবং সবগুলো আসনই ভরা ছিল। মহামারী সম্পর্কে কোনও সচেতনতা বা সামাজিক দূরত্বের বালাই আমি সেখানে দেখিনি। ভাগ্যক্রমে, ওই শোয়ে থাকার পরেও আমি বা আমার বন্ধ কেউই করোনায় আক্রান্ত হইনি। যুক্তরাজ্যে সে সময় সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। সেখানকার মানুষ করোনার ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে কেবলমাত্র একটি মৌসুমী ফ্লু ছাড়া বেশি গুরুত্ব দেয়নি।

প্রাথমিকভাবে, যুক্তরাজ্য সংক্রমন ছড়িয়ে পরার পর ব্যাপক হারে পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু মার্চ মাসে সরকার এই পথ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। সম্ভবত তারা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে যেন হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়, সেটা আশা করছিল। এর ফলে যেটা হলো যে, কোভিড-১৯ যুক্তরাজ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। হাসপাতালগুলো গুরুতর রোগীতে পূর্ণ হয়ে উঠলো।  বেশিরভাগ পরীক্ষার ফলাফল ৭২ ঘন্টা পর জানা যাচ্ছিল। বাড়তি রোগীর বোঝা সামাল দিতে বয়স্ক অনেক রোগীকে পরীক্ষার ফলাফল আসার আগেই কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই বৃদ্ধানিবাসে পাঠানো হয়েছিল। ২ মার্চ যুক্তরাজ্যে প্রথম করোনা ভাইরাসজনিত মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মৃত ব্যক্তিটি ছিলেন ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। এর পর সংক্রমণের হার এবং মৃত্যু খুব দ্রুতই বাড়তে থাকে।

লকডাউন নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কঠোর হতে না পারা, সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়া, সমন্বয়ের অভাব, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ট্রেসিং এবং বিচ্ছিন্নতার ভুল প্রোটোকল, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার যে বিশাল বড় শূন্যস্থান, তার ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছিল করোনা মহামারি।

ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সাথে দ্রুত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন যুক্তরাজ্যে বিশেষ করে লন্ডনজুড়ে মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ অবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ২৩ মার্চ দেশব্যাপী ললডাউন ঘোষণা করেছিলেন। প্রতিদিন পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে সরকার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কার্যকর কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এবং বিচ্ছিন্নতা এখনও তারা সঠিকভাবে বজায় রাখতে পারছে না। এখন অবধি সেখানে ১৫.৭ মিলিয়ন পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ৩০৭ জন। মারা গেছে ৪৬ হাজার মানুষ। ইউরোপে ২০২০ সালে জানুয়ারির পর থেকে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে যা কিনা ৫০ হাজারের বেশি। এটা স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, মহামারী ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় পাবলিক অবকাঠামো - এনএইচএস, সামাজিক সেবা, হাসপাতাল, পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম, ভেন্টিলেটর যুক্তরাজ্যের নেই। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে সেখানে অনেক লোককে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং বহু লোক মারা গেছে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে ছোট ছোট ভুলগুলোও বড় বিপদ ডেকে এনেছে। ইউরোপের জনগণ এবং বিশেষজ্ঞরা এখন মহামারী মোকাবেলায় যুক্তরাজ্য তথা ইউরোপের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।   

কোভিড-১৯: বাংলাদেশ

বিপর্যয় বা বড় বড় মানবিক সংকট বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের মানুষ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ প্রতিরোধ ছাড়াও ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও দুর্দান্ত স্থিতিশীলতা দেখিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতি এবং পরিসরের সংকট। এই সংকটের পরিসর এখনও পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। এটা স্পষ্ট যে,  বাংলাদেশের নেতাদের কাছে মানুষকে এই ভাইরাস বাঁচাতে এবং অর্থনীতিকে সচল রাখতে খুব কম বিকল্প ছিল।  যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকার যেমন মানুষকে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা দিয়েছে বাংলাদেশের সরকারের তেমন সামর্থ নেই। বাংলাদেশ ২২ জানুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগত সমস্ত যাত্রীদের তাপমাত্রা স্ক্রিনিং শুরু করে। এটি সমস্ত সমুদ্র এবং স্থলবন্দরগুলিতে স্ক্রিনিং ডিভাইসগুলি ইনস্টল করে। সমস্ত সমুদ্র এবং স্থলবন্দরগুলোতে স্ক্রিনিং ডিভাইস চালু করে। ৩১ জানুয়ারি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইট তিন চিকিত্সক, একজন নার্স এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে চীন এর উহান গিয়েছিল এবং ৩১২ জন বাংলাদেশী নাগরিককে (২৯৭ প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৫ শিশু) ফিরিয়ে এনেছিল যাদের বেশিরভাগই হুবেই প্রদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। সকলকে চীন থেকে বিমানে ওঠার আগে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং দেশে আনার ১৪ দিন পর্যন্ত তাদের পৃথক করে রাখা হয়েছিল। তাদের কেউই করোনা পজিটিভ হননি। ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার চীনা থেকে অন অ্যারাইভাল ভিসা স্থগিত করে। চীনের নববর্ষের জন্য চীন যাওয়া বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পের সাথে জড়িত সমস্ত চীনা কর্মীদের ফিরে না আসতে বলা হয় এবং বাংলাদেশের বাকী চীনা কর্মীদের সরকারী স্বাস্থ্য প্রোটোকল অনুসরণ করতে বলা হয়। ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশী প্রবাসীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও, ইউরোপ থেকে সমস্ত ফ্লাইট স্থগিত করার ব্যাপারে সরকার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিল। সমস্ত দেশের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা স্থগিত করা হয়েছিল। মানুষকে সরকারী / বেসরকারী পরিবহন এড়াতে বলা হয়েছিল।

প্রথম তিনটি পজিটিভ কেস ধরা পড়েছিল ৮ মার্চ, যারা কিছুদিন আগে ইতালি থেকে ফিরেছিল।  এরপরই সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সীমিত করে ফেলে। এছাড়াও বাংলাদেশ বাংলা নববর্ষ, ঈদ উত্সব এবং মসজিদগুলোতে ধর্মীয় জামাত স্থগিত এবং সীমিত করা হয়। ১৫ মার্চ ইতালি থেকে ফেরা ১৪২ প্রবাসীকে আশকোনা হজ ক্যাম্পে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনের সহিংস আচরণের কারণে তাদের টেস্ট সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ তাদের ক্যাম্প ছাড়ার অনুমতি দেয় এবং তাদের নিজ নিজ বাড়িতে সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয়। এটি মারাত্মক ভুল ছিল। প্রবাসীরা সরকারের অনুরোধ এবং প্রোটোকলগুলো অনুসরণ তো করেই নি, উল্টো তারা নিরাপত্তারক্ষীদের সাথেও অপমানজনক আচরণ করেছিল। ক্যাম্প ছাড়ার পরে তাদের সাথে যোগাযোগ এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়নি। সেখান থেকেই বাংলাদেশের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছিল।

১৭ মার্চ বাংলাদেশে আটজন শনাক্ত হওয়ার পর সরকার সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দিয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ করা হয়। ২৩ মার্চ বাংলাদেশ সরকার দশ দিনের দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করে (লকডাউনও বলা যেতে পারে), সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী অফিস বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। মানুষকে সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করতে এবং বাড়িতে থাকতে বলা হয়। তবে এটি সমন্বিতভাবে পালন প্রতিপালন করা হয়নি। ঢাকা এবং অন্যান্য শহর থেকে হাজার হাজার লোক গণপরিবহনে বাড়িতে গেছে, তারা সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করেনি বা বাড়িতেও থাকেনি। অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে অনেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেনি। এটি ছিল আরও টার্নিং পয়েন্ট যা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বাড়িয়ে তোলে। 

দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর সহ পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ। দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের মাধ্যমে সরকার সচেতনতা প্রচার শুরু করে। এটি বেসরকারী খাতের সহযোগিতার মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছিল। সরকার বেসরকারী পরিষেবা সরবরাহকারীদের সাথে মিলে ৫০০ টিরও বেশি টেলিফোন হটলাইন চালু করে। 

সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও টেস্ট, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এবং বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি নিজস্ব ঘোষিত প্রোটোকলগুলো মেনে চলতে বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। পরীক্ষার ক্ষমতা খুব ন্যূনতম ছিল এবং প্রাথমিকভাবে ঢাকার একটি মাত্র জায়গায় পরীক্ষা হতো। যদিও পরীক্ষার সক্ষমতা এখন বেড়েছে। কিছু কর্মকর্তা এবং কিছু বেসরকারী খাতের দুর্নীতির কারণে সরকারের সুদৃঢ় প্রচেষ্টাগুলো বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা ছিল এবং মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে সংক্রমণটা অনেক দেরিতে শুরু হয়েছিল, সেই সুযোগটা হাতছাড়া করেছিল স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। ভাইরাস বিস্তীর্ণ স্থল সীমানা অতিক্রম না করে মূলত ইউরোপ থেকে এসেছিল। প্রাথমিকভাবে ঢালাও পরীক্ষা, কঠোর কোয়ারান্টাইন এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ ছিল। কারণ এটি খুব স্পষ্টই ছিল যে, কেবলমাত্র বিদেশ থেকে আসাদের মাধ্যমেই এটা ছড়াচ্ছে। 

বাংলাদেশ, বিশেষত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেখিয়েছিলেন, সঠিক সময়ে খুব সাহসী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি ভাইরাস এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছেন এমন লোকদের সহায়তার ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য নেতৃত্ব ও নীতি নির্দেশনা প্রদান করেছেন। ভাইরাস এবং একই সঙ্গে ক্ষুধা প্রতিরোধ করা, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা সরবরাহ করার কাজ তিনি একই সঙ্গে চালিয়ে গেছেন। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ আমলাদের বিভিন্ন মধ্যে বোঝাপড়া, নেতৃত্ব, ধারাবাহিকতা এবং সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সুশীল সমাজ, বিশেষজ্ঞ, অনেক দলের সদস্য এবং বিরোধী নেতারা একটি বিভ্রান্তিমূলক এবং সমর্থনমূলক ভূমিকা পালন করছেন না। অনেক সংবাদ মাধ্যম বিভ্রান্তি এবং ভুল তথ্য সরবরাহ করছে। জনগণের একটি বৃহত্তর অংশ সরকারী প্রোটোকলগুলো অনুসরণ করছে না।

আজ অবধি বাংলাদেশ ২.২ মিলিয়ন পরীক্ষা চালিয়েছে এবং ২ লাখ ৪০ হজার ৭৪৬ জন শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছে ৩ হাজার ১৫৪ জন। ব্যাপক কমিউনিটি ট্রান্সমিশন সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনও মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের চেয়ে (১.৩%) কম রয়েছে। সংক্রমণের তুলনায় সুস্থতার হারও অনেক বেশি যা কিনা ৫৭ শতাংশ।

স্বাস্থ্য এখন বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান একটি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠছে। আমরা সকলেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আন্দোলনের সাথে একটি বিশ্বব্যাপী গ্রামে বাস করছি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যেকোনো বিষয়ের পরামর্শ দেবেন তবে কেবল রাজনীতিবিদরাই এটি বাস্তবায়িত করতে পারেন। কোভিড-১৯ এবং যে কোনও ভবিষ্যত মহামারী মোকাবেলায় আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সময়োচিত এবং সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। আমাদের ভয় পাওয়া উচিত নয় তবে অবশ্যই আমাদের ভুল থেকে শিখতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কোনও দেশ বা সরকার বা একা একজন ব্যক্তি সব সমস্য্যার সমাধান করতে পারেনি।  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭