ইনসাইড গ্রাউন্ড

চিরযৌবনা এক দাবা সম্রাজ্ঞী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 04/08/2020


Thumbnail

৭৬ বছর বয়সেও দিব্যি খেলে চলেছেন, জিতে চলেছেন। দাবা যার কাছে ধ্যান-জ্ঞান এবং ভালোবাসা। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার, নামের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁকে ডাকা হয় ‘দ্যা কুইন অব চেজ’ নামে। বাংলাদেশের দাবা জগতের একক সম্রাজ্ঞী এই রানী হামিদকে চেনেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। সাদা-কালোর ৩২ ঘরে রানী হামিদ অনন্য, ভারতবর্ষে ষষ্ঠ শতকে আবিষ্কার হওয়া এই খেলায় গৃহিণী থেকে দাবাড়ু বনে যাওয়া রানী বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন অসংখ্য সব অর্জন। ৭৬ বছর বয়সেও জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন হবার পরেও যার ক্ষুধা এতটুকুন কমেনি। লক্ষ্য ৭৭ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম তোলা!

সৈয়দা জসিমুন্নেছা খাতুন ১৯৪৪ সালে সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ডাকনাম রানী এবং বিয়ের পরে স্বামীর নাম যুক্ত করে রানী হামিদ হন। যেই নাম দিয়েই চার দশকের বেশি সময় যাবত দাবার কোর্টে ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। স্কুলজীবনে ভাল ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও এ্যাথলেট হওয়া সত্ত্বেও দাবাই ছিল রানীর প্রধান ভালবাসা। ১৯৫৯ সালে তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। স্বামী ক্রীড়াবিদ হওয়ায় দাবা খেলার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা পান।

ঢাকার নবদিগন্ত সংসদের এসএ মহসিন স্মৃতি দাবা প্রতিযোগিতায় রানী হামিদ প্রথমবারের মতো খেলতে নেমে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেন। এই সাফল্যে তার উৎসাহ অনেক বেড়ে যায়। শুরু হয় তাঁর কঠোর অনুশীলন। খেলতে থাকেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। দেশে তখনও জাতীয় পর্যায়ে মহিলা দাবা প্রতিযোগিতা শুরু হয়নি। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতার আসর অনুষ্ঠিত হয়। অনেকের মতো সেখানে নাম লেখান রানী হামিদ। সেখানেও চমক দেখান তিনি।

একবার-দু`বার নয়, এক এক করে পর পর টানা (১৯৭৯-১৯৮৪ সাল) টানা ছয় বার জাতীয় মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক অসামান্য রেকর্ড সৃষ্টি করেন তিনি। তাঁর পরের দুই বছর (১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে) ইয়াসমিন বেগম রানী হামিদের আধিপত্যকে কিছুটা খর্ব করলেও পরের বছর (১৯৮৮ সালে) রানী হামিদ তাঁর শিরোপা ফিরে পান। এরপর আবারও এক বছরের জন্য (১৯৮৯ সালে) সৈয়দা শাবানা পারভিন নীপার কাছে শিরোপা গেলেও আবার রানী সেটা পুনরুদ্ধার করেন।

কিন্তু এর পরের বছর আবার নতুন দাবা প্রতিভা তনিমা পারভিনের দখলে শিরোপা চলে গেলে রানী হামিদ কিছুটা দমে যান। পরের বছর আবার সেটা পেয়ে যান (১৯৯২ সালে)। মজার ব্যাপার হলো ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এক বছর অন্তর অন্তর রানী হামিদ জাতীয় মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হন। ইয়াসমিন, নীপা, তনিমারা দাবা অঙ্গন থেকে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু রানী এখনও সমান তালে পাল্লা দিচ্ছেন লিজা-ইভা-শিরিনের মতো ক্ষুদে তানিদের সঙ্গে। 

জাতীয় মহিলা দাবার পাশাপাশি জাতীয় দাবাতেও রয়েছে রানী হামিদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে মহিলা দাবাড়ুদের মধ্যে রানী হামিদই একাধিকবার খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। দাবা ক্রীড়াঙ্গনের এই নক্ষত্র তাঁর সাফল্যকে শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। দেশের বাইরেও রানী হামিদের নাম অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এক অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে তিনি ব্রিটিশ মহিলা দাবায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৩, ১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সাল) হবার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন।

সেই সঙ্গে উপমহাদেশের সেকালের বিশ্বখ্যাত দাবা খেলোয়াড় গ্রেট মীর সুলতান খানের ত্রিশ দশকের রেকর্ডটিও স্পর্শ করেন। এছাড়া ব্রিটিশ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে একবার, লয়েড ব্যাঙ্ক মাস্টার্স দাবায় একবার ও বিশ্বদাবা জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপে একবার রানার্স আপ হবার কৃতিত্ব দেখান। শহীদ মুফতি কাসেদ আনত্মর্জাতিক দাবা, সার্ক এয়ারলাইন্স দাবা ও এশিয়ান সিটি চেস চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হবার কৃতিত্ব দেখান তিনি। ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন থেকে ‘ফিদে’ খেতাব অর্জন করেন।

সবশেষ ৩৯তম জাতীয় মহিলা দাবায় ৭৬ বছর বয়সী রানী হামিদ তাঁর ঝুলিতে ভরেছে ২০তম শিরোপা। শুধু তাই নয়। রানী হামিদ একমাত্র নারী খেলোয়াড় যিনি দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে টানা ৬ বার চ্যাম্পিয়ন হন (১৯৭৯-৮৪)। এছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক দাবা খেলায় ব্রিটিশ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় তিনবার (১৯৮৩, ৮৫ এবং ৮৯)। রানী হামিদ একাধিকবার বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে শুধু মহিলা দল নয়, জাতীয় দলের হয়ে অংশ নেবার যোগ্যতা লাভ করেছেন। যে কৃতিত্ব বিশ্বের খুব কম মহিলা দাবাড়ুরই রয়েছে। স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ‘মজার খেলা দাবা’ ও ‘দাবা খেলার আইন কানুন’ নামে দু’টি বই লিখেছেন।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭