ইনসাইড আর্টিকেল

রেণু থেকে বঙ্গমাতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/08/2020


Thumbnail

বাংলায় প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। অর্থাৎ মানুষ তার কর্মের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। তেমনই এক কীর্তিমান মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। যিনি নিরহংকার, নির্লোভ, আদর্শ স্ত্রী, মাতা, গৃহিণী আর দক্ষ সংগঠক। বেগম মুজিব বিরূপ পরিস্থিতিতে ছিলেন অবিচল, নিয়েছেন সঠিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত। দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য সংগ্রামকেই প্রাধান্য দিয়ে, নিজেদের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে সংসার করেছেন। বেগম মুজিব জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বামীর সাথে থেকে নিরবে দেশ ও মানুষের সেবা করে গেছেন। মানুষের জন্য স্বামীর ত্যাগ ও সংগ্রামে নিরন্তন সহযোগিতা করেছেন, যা সত্যিই অনন্য, অতুলনীয়।দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর ভাবনা ইতিহাসে চিরভাস্মর হয়ে আছে। স্বামীর প্রতি বেগম মুজিবের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তাঁরা একে অপরের আত্মা হয়ে থেকেছেন, কাজ করেছেন। দু’জনের তীব্র ভালোবাসা ছাপিয়ে দেশের মানুষের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা প্রাধান্য পেয়েছে আমৃত্যু।

প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা, জওহরলাল নেহেরুর স্ত্রী কমলা এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সাথে তুলনা করতে গিয়ে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে "বঙ্গমাতা" অভিধায় ভূষিত করেন।

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তাঁর বাবার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম।দাদা শেখ আবুল কাশেম নাতনীর নাম রাখেন ফজিলাতুন নেছা। ফুলের মতো গায়ের রং বলে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। একভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শৈশবে মা-বাবাকে হারানোর পর শেখ ফজিলাতুন নেছা বেড়ে ওঠেন দাদা শেখ কাশেমের কাছে। সম্পর্কে তিনি জাতির পিতার আত্মীয় হতেন। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার। শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবর-ননদের সঙ্গেই তিনি বেড়ে ওঠেন।

২০১৭ সালে ৮ আগস্ট হতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন জাতীয়ভাবে পালনের সুপারিশ করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনের পর বঙ্গমাতার জন্মদিন জাতীয়ভাবে পালন হয়ে আসছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য সহধর্মিণী ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯০তম জন্মদিবস ডিজিটাল পদ্ধতিতে উদ&যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথমবারের মতো সরকারি উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের জন্মদিনও উদ&যাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ৫ আগস্ট সরকারিভাবে দিবসটি উদ&যাপন হয়েছে।

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার পেছনে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অনন্য সাধারণ ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে পর্দার অন্তরালে থেকে তিনি পরামর্শ, সাহস, অনুপ্রেরণা ও সকল কাজে সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। বঙ্গমাতার অবদান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে নেপথ্যে থেকে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি দুঃসময়ে প্রেরণা জুগিয়েছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী হয়ে তাঁর প্রতিটি কাজে প্রেরণার উৎস হয়েছেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতার সঙ্গে বুলেটের নির্মম আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে।

বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। দেশের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে পরিবারের জন্য বিশেষ করে নিজের স্ত্রীকে যথেষ্ঠ সময় তিনি দিতে পারেন নি। স্ত্রীর প্রতি জাতির পিতার ভালোবাসার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তার লেখায়। তিনি লিখেছেন,“রেণু তো নিশ্চয় পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নিরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।”

সারা জীবন শেখ মুজিবকে আগলে রেখেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বেগম মুজিবের গভীর ভালোবাসার কথাও উঠে এসেছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায়। বিদায় দেওয়ার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,“ রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নিরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমো দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবারতো কিছুই আমার ছিলো না, সবই তো ওকে বলেছি।”

বঙ্গবন্ধু বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি বেগম মুজিব। সবসময় জাতির পিতাকে সাহস যুগিয়েছেন, পরিবারের সদস্য ও দলের নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থল ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

-২-

বিভিন্ন হামলা-মামলা, বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়ে বেগম মুজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নেতাদের সঙ্গে বসতেন, বেগম মুজিব সবসময় খেয়াল রাখতেন কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তিনি সময়মতো তার মতামত দিতেন কিন্তু কখনো তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেন না। তিনি তার বার্তাটি পৌঁছে দিতেন। মায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,“অসহযোগ আন্দোলনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি দেখেছি মায়ের দৃঢ় ভূমিকা”।

বঙ্গবন্ধু জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছেন সবটাতেই বঙ্গমাতা তাঁকে ছাঁয়ার মতো সাহায্য করেছেন। তাঁর উৎসাহে বঙ্গবন্ধু কারাগারে আত্মজীবনী লিখেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’। জাতির পিতার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা ইতিহাসের সম্ভার এ গ্রন্থ দু’টি। (বঙ্গবন্ধুর লেখা তৃতীয় বইয়ের নাম ‘আমার দেখা নয়াচীন’)। এই আত্মজীবনী সংরক্ষণে বঙ্গমাতার ভূমিকা ইতিহাস নিশ্চয়ই মনে রাখবে। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, তুমি তোমার মনের কথাই সে সময়ে বলবে। তোমার স্বপ্নের কথা বলবে’।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু তাঁর মনের কথাগুলো বলেছিলেন বলে আজ এটি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতম স্থানে পৌঁছেছে। ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে `মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে` তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। 

স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এবং মুক্তিযুদ্ধের শুরু। তারপর একরকম বন্দিজীবন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি বিলাসী জীবনে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু নিজের গড়া ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থেকে যান। সারা জীবন ছায়ার মতো স্বামীর পাশেই ছিলেন। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি বলেছিলেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছো আমাকেও মেরে ফেল’। প্রচারবিমুখ মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পর্দার অন্তরালে থেকে দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়েছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছায়ার মতো থেকে শক্তি জুগিয়েছেন। একটি স্বাধীন দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। জাতির পিতার দীর্ঘ সংগ্রামে অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ক্রমেই হয়ে উঠেছেন বঙ্গমাতা।

এই মহীয়সী নারীর জীবন পরম গৌরবের। একদিকে তিনি জাতির পিতার পত্নী, শহিদ সন্তানদের জননী এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও জন্মদাত্রী। তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবন সংগ্রাম, শেখ মুজিবুর রহমানের কারাবাসকালে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংগঠিত করা এবং তার দেশপ্রেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আরও বেশি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ৯০তম জন্মদিবসে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭