ইনসাইড আর্টিকেল

এস এম সুলতান: তুলির আঁচড়ে জীবন আঁকতেন যিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 10/08/2020


Thumbnail

"আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলছি৷ আমার সকল চিন্তা, সবটুকু মেধা, সবটুকু শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করি তা কেবল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য৷ আমার ছবির মানুষেরা, এরা তো মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে স্ট্রাগল করেই এরা বেঁচে থাকে৷ এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুসকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম৷ শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাব্বে না এক ইঞ্চি৷ আসলে, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার৷ ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকম৷ ওদের মাসল যদি অতো শক্তিশালী না হয় তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে আছে কার উপর? ওই পেশীর ওপরেই তো আজকের টোটাল সভ্যতা৷"

কথাগুলো ছবিপ্রাণ মানুষ এস এম সুলতানের৷ তাঁর শিল্পচেতনায় ছিল স্বদেশ-ঐতিহ্য, প্রকৃতি-পরিবেশ ও মানুষ৷ মানুষ যে শক্তিময়তার দিক থেকে অনেক বড়- এ সত্যের পরিচয় মেলে সুলতানের সৃষ্টি করা ক্যানভাসে চোখ রাখলেই৷ তাঁর ছবিতে কখনো কৃশকায় মানুষ দেখা যায় না, দেখা যায় পেশীবহুল স্বাস্থ্যবান অবয়ব৷ প্রগাঢ় সাহসী জীবনবোধের এক নিবিষ্ট চিত্রকর এস এম সুলতান (শেখ মুহম্মদ সুলতান)৷ জীবনের শুরুতেই যাঁকে সবকিছু বাদ দিয়ে পেশীতে নির্ভর করে নির্বাহ করতে হয়েছে জীবিকা৷ লড়াই করতে হয়েছে দৈনন্দিন দারিদ্র্যের সঙ্গে৷ এ লড়াইয়ের জন্য কোমল পেশীতে সঞ্চার করতে হয়েছে শক্তি ও সাহস৷ পরবর্তী সময়ে তিনি যে মানুষকে শক্তিমান ও মহীয়ান করে চিত্রিত করেছেন তা নিছক শিল্প নয়, ঘনিষ্ট জীবনবোধ ও সমাজ বাস্তবতারও বহিঃপ্রকাশ৷

এস এম সুলতান ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত তথা বর্তমান বাংলাদেশের নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। শৈশবে পরিবারের সবাই তাকে লাল মিয়া বলে ডাকতো। অবধারিতভাবে তাঁকে বিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো সামর্থ্য তাঁর দরিদ্র পিতার ছিল না। তবুও বহু কষ্টে মেছের আলি তার সন্তান লাল মিয়াকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করান। এস এম সুলতান এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। এরপর স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরে বাবার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি সেই দালানগুলোর ছবি আঁকতেন। ১০ বছর বয়সে স্কুলে পড়ার সময় ড: শাম্যপ্রসাদ মুখার্জ্জী স্কুল পরিদর্শনে এসে তাঁর আঁকা ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল ছবি আঁকা শিখবেন। এজন্য প্রয়োজন হলে কলকাতায় যাবেন। কিন্তু এরকম আর্থিক সঙ্গতি তাঁর পরিবারের কখনোই ছিলনা। পরবর্তীতে তাঁর এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জমিদারের সাহায্য নিয়ে সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান। এরপরে তিনি ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিন বছর পড়াশোনা করেন এবং পাশ করে তিনি ফ্রিল্যান্স চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তার আরেকটা চমৎকার গুণ ছিল তিনি অনবদ্য বাঁশি বাজাতেন।

বিখ্যাত এই চিত্রকর চেতনায় ছিলেন ব্যক্তিস্বাধীন এবং প্রকৃতিগতভাবে ছিলেন ভবঘুরে এবং ছন্নছাড়া। প্রকৃতিকে তিনি সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন একই সাথে যান্ত্রিক নগর জীবনকে ঘৃণা করেছেন।

এস এম সুলতানের আঁকা ছবিগুলোতে বাঙালি কৃষকদের দৈহিকভাবে একরকম বলিষ্ঠ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং চিত্রকর বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃষকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো -সেটাও রোগা...। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিলো। দেশের অর্থবিত্ত ওরাই যোগান দেয়। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা র্গ্নু কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিৎ।’

গুণী এই চিত্রশিল্পীর আজ ৯৬তম জন্মবার্ষিকী। তার জীবনাবসান ঘটে ১৯৯৪ সালের ১০অক্টোবর, নড়াইলে, ৭১ বছর বয়সে। শেষ বয়সে তিনি শিশু শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেছিলেন যা নিয়ে তাঁর অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং চারুপীঠ নামে দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় তোলেন। এছাড়া সেখানে ‘নন্দন কানন’ নামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ‘নন্দন কানন স্কুল অব ফাইন আর্টস’ নামে একটি আর্ট স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭