ইনসাইড আর্টিকেল

বঙ্গবন্ধু হত্যায় তাহেরের ভূমিকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/08/2020


Thumbnail

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আবু তাহের, মেজর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারী পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাহের জিয়ার নেতৃত্বাধীন ‘জেড ফোর্সে’র সঙ্গে যুক্ত হন । ১২ আগস্ট তাহের ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব পান। সার্বিক দায়িত্ব জিয়ার কাছ থেকে তিনি ১০ অক্টোবর বুঝে নেন। ওই সময় জিয়া জেড ফোর্সকে নিয়ে সিলেট অঞ্চলে চলে যান। ১৪ নভেম্বরে তাহের একটা সামরিক অভিযানে দুর্ঘটনাবশত মাইনে পা দিলে মাইনটি বিস্ফোরিত হয় এবং তিনি গুরুতর আহত হন। পরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়। বাহাত্তরের নভেম্বরে তাকে সেনাবাহিনী থেকে লে. কর্নেল হিসেবে অবসর দেওয়া হয়। সরকার তাঁকে বেসামরিক পদে চাকরির ব্যবস্থা করে। তিনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অধীনে সি-ট্রাক বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। পঁচাত্তরের মার্চে তাঁকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ড্রেজার বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থাকা অবস্থায় তাহের বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন । তিনি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ শিকদারের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ছুটি নিয়ে ঢাকায় কলাবাগানে তার বড় ভাই বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট আবু ইউসুফের বাসায় সিরাজ শিকদারের দলের কিছু কর্মীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৭১ সালের ৩ জুন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নাম পাল্টে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি রাখা হয়। এই দলের সঙ্গে তাহেরের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে তিনি নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে (জাসদ) যোগ দেন। তবে সর্বহারা পার্টির সঙ্গে তার যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। চুয়াত্তরের জুন মাসে জাসদের সামরিক সংগঠন বিপ্লবী গণবাহিনী` তৈরি হলে তাকে এই বাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার নিয়োগ করা হয়।

সেনাবাহিনী ছেড়ে এলেও সেনা কর্মকার তাহেরের যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। এ প্রসঙ্গে সেনা কর্মকর্তা, ডালিম বলেন, `...আমাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি কখনো, আমরা আমাদের স্ব স্ব অবস্থানে থেকে একই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকি।

তাহের নানা কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। সরকার উৎখাতের আন্দোলনে তিনি যুগপৎ জাসদ ও সর্বহারা পার্টির পক্ষে কাজ অব্যাহত রাখেন। সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাহের মাও সে তুংয়ের রচনাবলি পড়তেন এবং এগুলো তাঁর গাড়িচালকের মাধ্যমে সেনানিবাসে জিয়ার কাছে পাঠাতেন। জিয়ার ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনি সেনানিবাসের ভেতরে সাধারণ সৈন্য । কমিশন্ড এবং জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের নিয়ে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা না একটা গোপন সংগঠন তৈরি করেন।। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরের বছরগুলোতে যেসব সেনা কর্মকর্তা সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং একটা রক্তক্ষয়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজনীতির পালাবদল ঘটাতে চেয়েছিলেন, তাহের ছিলেন তাদের অন্যতম। তাহের ও জিয়াউদ্দিন পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন । সমসাময়িক পরিস্থিতি ও রাজনীতি সম্পর্কে তাহেরের পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি বোঝা যায় পরবর্তী সময়ে (১৯৭৬ সালের জুন-জুলাই) বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের সময় দেওয়া তাঁর জবানবন্দি থেকে। এখানে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :

সব ধরনের শোষণ ও আধিপত্য থেকে মুক্তি পাব, এই আশা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলব । কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর কী হলো? যুদ্ধের বেশির ভাগই আমাদের মাটিতে হয়নি এবং এর সুফল জনগণ সামান্যই পেল । নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় ও সন্ত্রস্ত মানুষ নিরাপত্তা ও খাবারের আশায় সীমান্ত পাড়ি দিল। বেশির ভাগ সৈনিকও তা করল । নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, একই কারণে সীমান্তের ওপারে গেল। আওয়ামী লীগ যেহেতু জনগণের রায় পেয়েছিল, তাদের দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। দুর্ভাগ্য এই যে নিরস্ত্র জাতির। সামনে কেমন দিন অপেক্ষা করছে, তারা কখনো তা ভাবেনি। সামনের ভয়ানক দিনগুলোর জন্য তারা জনগণকে তৈরি করেনি।...এ জন্য আমাদের চড়া দাম দিতে হলো। আওয়ামী নেতৃত্ব যদি আন্তরিকভাবে আমাদের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সাহসী ভূমিকা রাখত, তাহলে ঘটনাপ্রবাহ হতো অন্য রকম। কিন্তু তা হলো না।...

গণযুদ্ধের স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়া হলো। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে বীরের মতো লড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের প্রেরণা দেওয়ার জন্য কেউ ছিলেন না। যদি বাইরের হস্তক্ষেপ না থাকত, তাহলে দেশের ভেতরে কার্যকর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব গড়ে উঠত ।...

আমার চিন্তাভাবনা কর্নেল ওসমানীর অসন্তোষের কারণ হলো। তার জীবনটা ছিল খুব আরামের। ঘুমানোর জন্য তার একটা নিরাপদ আবাস ছিল এবং সেক্টর সদর দপ্তরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখার মতো অঢেল সময় ছিল তার। কিন্তু যা চলছিল, তা নিছকই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তামাশা। নেতারা ছিলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন। জনযুদ্ধ আর প্রথাগত যুদ্ধের মধ্যে অনেক ফারাক। কর্ণেল ওসমানী এটা বুঝতেন না। এক মুক্ত এলাকায় অস্থায়ী সরকারকে সরিয়ে আনতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান করা যেত। সেক্টর সদর দপ্তরগুলো এবং সব কর্মকর্তার উচিত ছিল ভারতীয় ভূখণ্ড ছেড়ে বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসা। আমি এই প্রস্তাব দিলে মেজর জিয়া তখনই একমত হন।...সেক্টর কমান্ডারদের একটা সভায় কর্নেল ওসমানী, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর সফিউল্লাহ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তাঁরা সেক্টর হেডকোয়ার্টারগুলো বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে আসার বিরোধিতাই শুধু করেননি, তারা মেজর জিয়ার ব্রিগেডকে আমার সেক্টর থেকে সরিয়ে দেন।...।

১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর খপ্পরে পড়ল। নেতৃত্বের নির্লিপ্ততা, দেওলিয়াপনা ও অযোগ্যতার কারণে অস্থায়ী সরকার ছিল অকার্যকর। ফলে ভারতের নাক গলানোর সুযোগ তৈরি হয়। ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকার কারণে আমাদের নিয়মিত বাহিনী ছিল মানসিকভাবে দুর্বল ও নতজানু। ভারতীয় বাহিনী যখন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে পা রাখল, তখন তারা একটা দখলদার বাহিনীর মতো সবকিছুই কবজা করল ।... শুরু হলো মতবিরোধ। মুজিব সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখাল। রক্ষীবাহিনীর মতো একটা কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করল। রক্ষীবাহিনী তৈরিতে ভারতের কর্মকর্তা ও উপদেষ্টাৱা সরাসরি জড়িত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আমি এর প্রতিবাদ করেছিলাম। যুদ্ধের সময় ভারতের সঙ্গে করা গোপন চুক্তির ব্যাপারেও আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।...এ সময় সরকারের সঙ্গে লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিনের মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে জিয়াউদ্দিন ও আমি সেনাবাহিনী থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৭২ সালের নভেম্বরেই এটা ঘটল এবং জিয়াউদ্দিন ও আমি নিজ নিজ রাজনীতি বেছে নিলাম। যখনই সম্ভব হতো, আমরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতাম।..

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভূমিকা সবারই জানা। কীভাবে একটার পর একটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল। আমাদের লালিত সকল আকাক্ষা, স্বপ্ন ও মূল্যবোধ একের পর এক ধংস করা হয়। গণতন্ত্রকে অত্যন্ত নোংরাভাবে কবর দেওয়া হয়েছিল। জনগণকে পায়ে পিষে জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র।

শেখ মুজিব জনগণের নেতা ছিলেন। অস্বীকার করার অর্থ হবে সত্যকে অস্বীকার করা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তার ভাগ্য নির্ধারণের ভার জণগনের ওপরই বর্তায়। জনগণের উচিত হবে জেগে ওঠা এবং প্রতারণার দায়ে মুজিবকে উৎখাত করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জনগণ মুজিবকে নেতা বানিয়েছে, তারাই একদিন স্বৈরাচারী মুজিবকে ধ্বংস করবে। জনগণ কাউকে ষড়যন্ত্র করবার অধিকার দেয়নি।

তাহেরের এই জবানবন্দি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব সম্পর্কে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। তার মতে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন, সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছেন এবং চালু করেছেন ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র । মুজিব সরকারকে উৎখাত করাই তাহেরের ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য তাহেরকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।

(বিএনপি সময়- অসময় বই থেকে সংকলিত; পৃষ্ঠা ৩৩-৩৬)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭