ইনসাইড আর্টিকেল

বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ডের পেছনে ‘পাকিস্তানী সুর’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/08/2020


Thumbnail

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘গৃহযুদ্ধের’ দোহাই দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়েছে।

‘ইসলাম বিপন্ন’- একথাটি পাকিস্তানে খুব বেশী শোনা যেত। ইসলামের দোহাই আজ থেকে নয়, পাকিস্তান বিভক্তির সময় থেকেই প্রচলিত এবং মিশরের বাদশাহ ফারুক একবার বাধ্য হয়ে বলেছিলেন, মনে হয় পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ইসলাম বলতে কিছু ছিল না। বাদশাহ ফারুকের এই মন্তব্যকে একটু ঘুরিয়ে ঢাকার একজন সম্পাদক বলেন, “মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও বৃটিশদের সাহায্যে গড়া পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে “ইসলাম কখনোই বিপন্ন ছিল না।”

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ইসলাম বিপন্নের দোহাই দিয়ে সামরিক বাহিনীই আগে বা পরে ক্ষমতা গ্রহণ করবে এটাই ছিল পাকিস্তানের নিয়তি।।

জেনারেল জিয়াউল হক খুব গর্বের সাথে বলেন, “পাকিস্তানে ঐতিহ্যগতভাবে সবসময় শান্তিপূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে আসছে।”

পাকিস্তানের ঐতিহ্যই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা।

অপরদিকে, বাংলাদেশের জনগণের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ঐতিহ্য রয়েছে। সেই নেতা ও সামরিক জান্তাকে তারা কোনদিনই মেনে নেয়নি যারা সাম্প্রদায়িকতার দোহাইয়ের বিনিময়ে রাজনীতি করতে চেয়েছে। মুজিব নিহত হবার পর বাংলাদেশেও পাকিস্তানের মতো ‘ইসলাম বিপন্ন` কিংবা ‘গৃহযুদ্ধের’ সুর শোনা যেতে লাগল।

স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রের শুরু এবং যারা মুজিবকে হত্যার ছক এঁকেছিল তারাই হল সেই ষড়যন্ত্রকারী।

স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল কিন্তু সবার বিশ্বাস তারাও স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে কাজ করেছে যা পরবর্তীকালে সামান্য সন্দেহের সৃষ্টি করলেও এটা ষড়যন্ত্রকারীদের দারুণভাবে সাহায্য করেছিল। এই ‘ক্যু’ যদি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকাশ্য বিরোধী শক্তি নিজেরাই করত, তবে খুব তাড়াতাড়ি বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ সৃষ্টি হতো। তাই তারা তা না করে এমন লোকদের দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। যাতে সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে মেজরদের নেতৃত্বাধীন আক্রমণকারী তিনটি দলই ছিল পাকিস্তানী সৃষ্টি এবং অন্যান্য পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তাদের মতো তারাও মনে করত তাদের জন্মই হয়েছে ক্ষমতায় বসার জন্যে। এবং তারা জাঁকজমক মোহের শিকার- ফারুকের মধ্যে এ মনোভাব ছিল সবচেয়ে বেশী।

এই মেজরদেরই কয়েকজন ছিল পাকিস্তানের ‘অপারেশন ফনিক্স’ এর অংশ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ইসলামের নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর এতই জঘন্য অত্যাচার করেছিল যে দেশ স্বাধীন হবার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রতিদিন প্রচলিত ‘ইনশাল্লাহ এবং ‘আসসালামু আলাইকুম` শব্দ দুটি শুনলেও ফেটে পড়তো। তাদের এ ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করার কারণ হল ইসলামে বলে দাবীদারদের হাতেই তাদের ভাই নিহত হয়েছে এবং লুণ্ঠিত হয়েছে বোনের ইজ্জত।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অতিমাত্রার অত্যাচার সম্পর্কে একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক অসহ্য হয়ে বলেন, “এই সব ইসলামের রক্ষক বলে দাবীদাররা হলো খুনী, লুণ্ঠনকারী এবং ধর্ষণকারী। পাকস্তানী হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে তাদের অপরাধ সম্পর্কে উল্লসিত। পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তারা বাঙালীদের উপর হাজার বছর ধরে শোষণ চালিয়ে যাবে। ১৯৭১-এর এপ্রিলে যখন পাক হানাদাররা মনে করে তারা বাঙালীদের চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে তখন পাকিস্তানী এক কর্ণেল করে বলেন, পাকিস্তান এখন আর কায়েদে আযমের পাকিস্তান নেই। এটি একটি অঞ্চল মাত্র। বাঙালীরা উপনিবেশের কথা বলছে। তারা একদিন এর অর্থও ও পারবে এবং তারা আর কোনদিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা স্বপ্নেও কল্পনা করবে না।”

১৯৭১ সালে ডের পিগেল” নামে একটি সংবাদপত্রকে পাকিস্তানের একজন কর্ণেল বলেন, “এরকম ত্রাস সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে করে আগামী তিন প্রজন্মের বাঙালীরাও স্বাধীনতার কথা চিন্তা না করে।”

যদিও চার বছর পূর্ণ হবার আগেই বাঙালীদের ওপর ইসলামের নামে পাক বাহিনীর বর্বরতার স্মৃতি ফারুক ও রশীদ বেমালুম ভুলে বসে। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে ইংল্যান্ডের সানডে টাইমস পত্রিকাকে ফারুক বলে, মুজিব তার আস্থার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ইসলামই হচ্ছে আমার জনগণের ধর্ম এবং ইসলামই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্দীপনা যোগাবে। ফারুক বলে যে, তার মতে বাংলাদেশের জন্য ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে ২০ লক্ষ লোক প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল সাড়ে চার বছরের স্বল্প পরিসরেই সেই বাংলাদেশকে মুজিব প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। সংখ্যাটি ২০ লক্ষ নয় ৩০ লক্ষ। কিন্তু ফারুক ভুল করে মুজিবের শাসনকাল একবছর বাড়িয়ে বলল যা একদম বেমানান। ফারুক বোধ হয় ভুলক্রমে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারীর পরিবর্তে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে হিসেব করেছিল। যেদিন মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

ফারুকও কি ইয়াহিয়া খানের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালীদের কষ্ট ও দুর্দশার জন্য মুজিবকে দায়ী করতে চায়, এ কথা বলার মতো সাহসও যেন তার না হয়? যারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় আসত, ফারুক তাদের মতো অতিমাত্রায় কৃত্রিম বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা দিতে লাগল। এমনকি মানসিক চেতনা আচ্ছন্ন পাকিস্তানী জেনারেল এবং নৈতিক চরিত্র কলুষিত অনেক রাজনীতিবিদরা একথা বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল বাঙালী নেতারা সত্যিকার মুসলমাননন।

তাহেরউদ্দিন ঠাকুর কুয়েতের দৈনিক আল রাই আল আমান পত্রিকাকে বলে, “শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাই বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধ রুখে দিয়েছে।” দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষার্থে নারী এবং এমনকি নিস্পাপ শিশুদেরও হত্যা করা, এ যেন ভূতের মুখে রাম নাম।

‘হু কিলড মুজিব` বই থেকে সংকলিত

 

[ভারতীয় সাংবাদিক এ এল খতিবের সাংবাদিকতা জীবনের বেশির ভাগ কাটে ঢাকায়। তিনি কাছ থেকে দেখেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। ১৫ আগস্টের পূর্বাপর ঘটনা বিবৃত হয়েছে তাঁর হু কিলড মুজিব বইয়ে।]

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭