কালার ইনসাইড

‘আগস্ট ১৯৭৫’ যেভাবে নির্মাণ হলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/08/2020


Thumbnail

‘আগস্ট ১৯৭৫’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছে শাপলা মিডিয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসের কলঙ্কময় এই দিনকে নিয়ে এর আগে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণ হয়নি। এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। সেই ঘটনার পরের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে এই সিনেমায়। কী আছে এই সিনেমায়?

সিনেমার প্ল্যানিং:

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়ার সঙ্গে পরিচালক শামীম আহমেদ রনির প্রথম ছবি ‘শাহেনশাহ’। বছর দুই আগের কথা। ‘শাহেনশাহ’র কাজ তখনও শেষ হয়নি। প্রযোজক সেলিম খান রনিকে ডেকে বললেন আমরা কি ১৫ আগস্ট নিয়ে কিছু করতে পারি না? এখানে উল্লেখ্য সেলিম খান একজন আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। সেলিম খান বললেন, আমরা ১৫ আগস্ট নিয়ে অনেক গল্পই কিন্তু জানি না। আমরা অনেক সময় অনেক গল্প পড়ি। কিন্তু ১৫ আগস্টের পরের দিন কি ঘটেছিল? বঙ্গবন্ধুর দাফন কিভাবে হয়েছিল? এগুলো নিয়ে কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না। এটা নিয়ে কি বড় করে কিছু করা যায় না? পরিচালক সায় দিলেন। প্রযোজক উৎসাহ দিতে থাকলেন। এরপর শুরু হয় একটা টিম নিয়ে গবেষণা।  বঙ্গবন্ধুর লাশ ১৫ তারিখ সারাদিন পড়ে ছিলো ৩২ নম্বরে। ১৬ তারিখে তার লাশের ব্যবস্থা করা হয়। পরিচালক রনি বলেন, ‘ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই দিনের যারা যারা বেঁচে আছেন তাদেরকে আমরা খোঁজার চেষ্টা করি। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কথা হয়। কে এম শফিউল্লাহ থেকে শুরু করে লাশ দাফনে যারা যুক্ত ছিলেন। সেটা প্রায় দেড় বছরের মতো সময় গেছে আমাদের এই রিসার্চে। রিসার্চ কমপ্লিট হওয়ার পর আমরা স্ক্রিপ্টটা করি। ১৫-১৬ তারিখে কি ঘটনা ঘটেছিলো সেটা সবার সঙ্গে কথা বলে একটা জায়গায় এসেছি। যে এটাই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য।

উদ্দেশ্য:

রিসার্চটা করতে গিয়ে মনে হয়েছে আসলেই এই ঘটনাগুলোর খুঁটিনাটি এই প্রজন্ম অনেকেই জানে না। স্পেশালি নতুন প্রজন্ম জানেই না। তৎকালীন মানুষেরা হয়তো কমবেশি সবাই জানতেন। জেনেও একটা লম্বা সময় তারা মুখ খুলতে পারেননি।’ প্রযোজক সেলিম যোগ করেন, ‘একটা লোক যে কোন রাজনৈতিক দলই করতে পারে। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু’ কিন্তু সবার ওপরে। বঙ্গবন্ধুর যখন জানাযা হয়েছে তখন কেন ২০/২৫ জন লোক ছিলো। হয়তো অনেকে অনুমান করে নেয় যে ওদের ভয়ে। কিন্তু আসলেই সেদিন কি কি ঘটেছিলো? আশেপাশের ১৯ জেলা কারফিউ দিয়ে ব্লক করে রাখা হয়েছিলো। মানুষ কিভাবে আসবে? ওরা মুসলমান হয়ে ডিরেক্ট কফিনসহ কবরে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে। এটা কয়জন মানুষ জানে?’ মৌলবী হালিম, কনস্টেবল সিরাজ, কে কিভাবে ছিলেন সেই অবস্থায়? মেজর হায়দার যার দায়িত্বে ছিলো টুঙ্গিপাড়া নিয়ে গিয়ে লাশ দাফন করা। সেটা কোন সিচুয়েশনে নিয়ে গিয়ে লাশ দাফন করা হয়েছে। এমনকি যারা আওয়ামী লীগ করে এই প্রজন্ম তারাও অনেকে এই প্রকৃত ইতিহাসটা জানে না। পরিচালক- প্রযোজকের এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় চাওয়া। 

প্রযোজক সেলিম খান বলেন,‘আমরা চেয়েছি এই ইতিহাসটা মানুষকে জানাতে। এবং সেটা একদম সত্য ঘটনা। যারা যারা ওই সময়ে ছিলো তাদের কাছ থেকে যেটা শুনেছি ওটাই আমরা স্ক্রিপ্টে এনেছি, ওটাই শ্যুট করেছি। আমরা এক বিন্দুও মিথ্যা বলিনি। এক বিন্দুও কল্পনা থেকে করিনি। এটা করার কারণ মানুষ প্রকৃত ইতিহাসটা জানুক।’

অভিনয়শিল্পীদের বক্তব্য:

সিনেমায় অভিনয় করেছেন একঝাক অভিনয়শিল্পী। ৭৫ সালের ভয়াল ১৫ আগস্টের পরদিন থেকে ছবির গল্প শুরু হবে। তাই এতে বঙ্গবন্ধু বা উনার পরিবারের কোনও চরিত্র থাকছে না। তবে এতে বেইমান খন্দকার মোশতাক ও জাতীয় চার নেতার মতো ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো থাকবে। খন্দকার মোশতাক হিসেবে আছেন শহীদুজ্জামান সেলিম ও জাতীয় চার নেতার একজন হিসেবে আছেন তৌকীর আহমেদ। খন্দকার মোশতাকের চরিত্রটা ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণিত চরিত্র। কিভাবে নিজের মধ্যে নিয়েছেন চরিত্রটা? সেলিম বলেন,‘প্রথমেই বলবো চরিত্রটাকে আমি ঘৃণা করতে পারিনি। তাহলে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারতাম না। চরিত্রটাকে আমার ভালোবাসতে হয়েছে। ভালোবেসে নিজের মধ্যে নিতে পেরেছি। এমন একটা চরিত্র তার জন্য প্রাকটিস তো ছিলোই। কিন্তু আমার জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের ব্যাপার ছিলো চরিত্রটাকে আমি ঘৃণা করতে পারিনি। আর কিছু ব্যাপর তো ছিলো, সে কিভাবে হাটতো। কিভাবে কথা বলতো। সেটা কিন্তু ৮/১০ জন মানুষের মতো নর্মাল না। খন্দকার মোশতাক কখনো ‘ছ’ বলতে পারতো না। উনি সবসময় ‘চ’ বলতো। এটা কিন্তু রপ্ত করতে হয়েছে।’ 

তৌকির আহমেদ বলেন, ‘যখনই তাজউদ্দিন সাহেবের চরিত্রের কথা ওঠে। সবাই আমাকেই ভাবেন। এটা হয়তো আমার একটা বাড়তি পাওয়া যে এই মহান মানুষটার সঙ্গে আমার কিছু মিল পায়। বঙ্গবন্ধুর পরে তাজ উদ্দিন সাহেব বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই সিনেমায় এই চরিত্রটা অনেক বিশরদ করে না। ওই দিন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম কাছের মানুষটার অনুভূতিটা কি হতে পারে। সেটা তুলে ধরেছি। একটা বেদনার চরিত্র। একটা মানুষের সব হারানো চরিত্র।’ 

নাবিলা বলেন, আমি অভিনয় করেছি বেবী মওদুদের চরিত্রে। অভিনয়ে আমি সব সময় নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই। যখনই জানলাম বেবী মওদুদের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে, তখন তাঁর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখে তাঁর কথা বলার ধরন, বাচনভঙ্গি রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। কাহিনির প্রেক্ষাপট নিয়ে পড়াশোনাও করেছি। শুটিংয়ের আগে দুই দিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ১৫ আগস্টের সেই গুলির আওয়াজ কিন্তু বেবী মওদুদও শুনতে পেয়েছিলেন। তার বাসাও ছিলো ৩২ নম্বরের কাছেই।’

আনিসুর রহমান মিলন বলেন,‘শুটিংটা হয়েছে একটা থমথমে পরিস্থিতিতে। ওই ক্যারেক্টারগুলো যে ধারণ করেছে সে আসলে অন্য কিছু বলতে পারেনি। সেটে এসে সে আসলে একটা পরীক্ষার আগে যেমন মানুষের ভিতর যেমন একটা ভয় কাজ করে। সবার মধ্যে তেমনটা দেখেছি। প্রতিজন অভিনয়শিল্পী এত সিরিয়াস ছিলো যে সেটা সত্যিই অবাক করার মতো। আর যেটা হয়েছে অনেক জায়গায় আবেগটা আমাদের এত এসেছে যে কান্না ধরে রাখতে পারিনি। ক্যামেরাম্যান শ্যুট করতে পারছিলেন না। তিনি নিজেও এতটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলেন। এই সিনেমায় তো অনেক গুণী গুণী অভিনয়শিল্পী অভিনয় করেছেন। তারা তো আবেগের দৃশ্য হাজারবার করেছেন। কিন্তু এই চরিত্রগুলো করতে গিয়ে তাদের শরীরের লোম দাড়িয়ে গেছে। তারা ঠিকভাবে নিতে পারছিলেন না। অনেকেই বলেছে, আমরা বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করি। কিন্তু এই ইতিহাসটুকু তো আমরা জানতাম না।’ 

একটা দৃশ্য ছিলো বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন হয়ে গেছে। কনস্টেবল সিরাজের ক্যারেক্টারটা করেছেন আনিসুর রহমান মিলন। আর্মিরা লাশ দাফন করে চলে গেছে পুলিশদের দায়িত্ব দিয়ে। একটা দৃশ্য আছে কবরের পাশে উনি আসে। এসে স্যালুট দেয়। ওই জায়গাটায় আমাদের প্রযোজকও ছিলেন। ওই দৃশ্যটা দেখে সবাই কেঁদে উঠছে। একটা কান্নার রোল উঠে গেছে। সবাই এত ইমোশনালী হয়ে গেছিলো বলে জানান মিলন। 

পরিচালক রনী বলেন, ‘অনেক শিল্পী অনেক ক্যারেক্টার করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর রক্ত বুকে নিয়ে শুটিং করবো। এটা তারা নিতেই পারেনি।  প্রত্যেকটা ক্যারেক্টারের জন্য আমরা যত ডকুমেন্ট পেয়েছি তাদের কাছে দিয়েছি। তারা নিজেরাই সংগ্রহ করেছেন। একদম ছোট ক্যারেক্টারগুলোও। মোশতাক সালাম কিভাবে নিতো। মুখে কিভাবে হাত দিতো। তাজউদ্দিন সাহেব চশমাটা কিভাবে চোখে পড়তো। যে জিয়াউর রহমান ক্যারেক্টারটা করেছেন সে ওটা ধারণ করেছে। সে কিভাবে হাটতেন। কিভাবে কথা বলতেন। সানগ্লাসটা কিভাবে ধরতেন।’ 

চরিত্র নির্বাচন:

পরিচালক রনি বলেন, ‘চরিত্র নির্বাচনে প্রথমেই আমরা খুঁজেছি লুক অ্যালাইক। কিন্তু এর সঙ্গে ঝানু অভিনয়শিল্পী খুঁজেছি। কারণ একটা দুর্বল চরিত্র পুরো সিনেমাটা নষ্ট করে দিতে পারে। এখানে অনেক সিনিয়র অভিনয়শিল্পী যেমন আছেন তেমনি কিছুটা অপরিচতরাও আছেন। তবে সেই অপরিচিতরাও কিন্তু নিজেকে কোথাও না কোথাও প্রমাণ করেছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ সাহেব কিভাবে কথা বলতেন। কিভাবে সে চশমাটা খুলতেন।কিভাবে কথা বলার সময় চশমাটা হাতে ধরে রাখতেন এগুলো কিন্তু আমাদের অনেক রিসার্চ করতে হয়েছে। আমরা রিসার্চ করতে গিয়েই এমন খুঁটিনাটি অনেক কিছুই জেনেছি।’

বাজেট:

পরিচালক রনি বলেন, ‘প্রযোজক আমাকে বলেছে তুমি একটা ভালো সিনেমা বানাও। ভালো অভিনয়শিল্পী কাস্টিং করো। তাতে যে খেরচ লাগে সেটা আমি দেবো। এটা থেকে ব্যবসা করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য না। আমরা আমাদের জায়গা থেকে জাতির কাছে যেন কিছু একটা দিতে পারলাম সেটাও বড় বিষয়।’ 

সিনেমাটি মাত্র ১৪ দিনে শুটিং কমপ্লিট করা হয়েছে। এই ১৪ দিনে প্রায় ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এফডিসিতে এর জন্য সেট নির্মাণ করতে হয়েছে। কারণ ওই সময়ের মতো বাড়িঘর এখন পাওয়া সম্ভব নয়।

মুক্তি:

প্রযোজক বলেন, ‘একটা ইতিহাসকে প্রেজেন্ট করতে যাচ্ছি। এটাও একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। ১৪ তারিখ সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার প্লানিং ছিলো। কিন্তু আমরা ১৪ তারিখ পারছি না। ২১ তারিখে ছবিটা রিলিজ করবো। তথ্য মন্ত্রণালয় আমাদের একটা আশ্বাস দিয়েছে যে আমরা যদি সেন্সরটা পেয়ে যাই। এই ছবিটার জন্য সীমিত সময়ের জন্য হলেও হলগুলো খুলে দেবে। ’

কে কোন চরিত্রে অভিনয় করেছেন:

তৌকির আহমেদ- তাজউদ্দিন আহমেদ
শহীদুজ্জামান সেলিম- খন্দকার মোশতাক
আনিসুর রহমান মিলন- কনস্টেবল সিরাজুল হক
মাজনুন মীজান- মেজর ডালিম
নাবিলা- বেবী মওদুদ
সুইটি- জোহরা তাজউদ্দীন
শাহেদ আলী- প্রণব (রেডিও স্টেশন শিফট ইনচার্জ) 
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় - মৌলভি আবদুল হালিম
ফজলুর রহমান বাবু- বায়োস্কোপওয়ালা
মুনিরা মিঠু- মৌলভির স্ত্রী
তুষার খান- শেখ মান্নান
জিয়াউর রহমান- আশরাফুল আশীষ
খালেদ মোশারফ- আগুণ
দিলারা জামান- বেবী মওদুদের মা

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭