ইনসাইড আর্টিকেল

বঙ্গবন্ধুকে হারানোর ৪৫ বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 15/08/2020


Thumbnail

কবি-মনীষী অন্নদাশংকর রায় বাংলাদেশের আরেক নাম রেখেছেন Mujibland। এক অর্থে, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৭ মার্চ ১৯২০। তাকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে। সে হিসাবে মাত্র ৫৪ বছর বেঁচেছিলেন এই জাতির পিতা। এর মধ্যে রাজনীতির জীবন ৩৫/৩৭ বছরের। এর মধ্যে কারাগারে কেটেছে মোটামুটি ১২/১৩ বছর। যদি ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার সাক্ষাতের সময় থেকে রাজনীতির যাত্রা ধরা হয় তাহলেও ৩৭ বছর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ফজিলেতুননেসা রেণুর সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৩৮ সালে, সে হিসাবে বিবাহিত জীবনও ৩৭ বছরের। তিন পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল এবং দুই কন্যা- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা । তার সঙ্গে স্ত্রী ও তিন পুত্রই ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে নিহত হয়েছেন। বিদেশে অবস্থান করায় দুই কন্যার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে, এখনো বেঁচে আছেন।

বঙ্গবন্ধুর আগে, তার সময়ে, তার পরে অনেক রাজনীতিবিদ তারচেয়ে হয়তো অনেক দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন, পাবেন, কিন্তু তার মতো ইতিহাস সৃষ্টি করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি, হবে না। কারণ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামে তার একক অবদান আর কারো সঙ্গেই তুলনীয় নয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ ছিল বাংলাদেশের ভিত্তির চার মূলনীতি। তাঁরা জানতো যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই এই মূলনীতিগুলো রক্ষা করার আর কেউ থাকবে না। এখানে তৈরি করতে পারবে এক মিনি পাকিস্তান। তারা জানতো যে বাঙালিকে আর পাকিস্তানী করা যাবে না, তবুও সৃষ্টি করতে হবে এমন একটি রাষ্ট্র যা চলবে পাকিস্তানের ছায়ায় যেখানে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বকে এই উপমহাদেশে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করা যাবে। রক্ষা করা যাবে কায়েমী স্বার্থ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, কেবল ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফলও নয়। এর পিছনে ছিল গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা দখলের অদম্য আকাঙ্খা।

অনেকে এটাকে সামরিক অভ্যুত্থান বলে মনে করেন। এটাকে সামরিক অভ্যুত্থান বলা চলে কি না সেটা আলোচনা সাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক আইনে সেই অবস্থাকে ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থান বলা হয় যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সাংবিধানিক বহির্ভূত উপায়ে হঠাৎ বা জবরদস্তিমূলক ভাবে গ্রহণ করা হয় এবং সাধারণত এটা সামরিক বাহিনীর একটি অংশ বা সমগ্র সামরিক বাহিনী দ্বারা সংঘঠিত হয়। ১৯৭৫ এর আগস্ট হত্যাকাণ্ডে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন জুনিয়র অফিসার জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে দুজন চাকরিচ্যুত এবং বাকী ৫ জন মেজরপদের। এদের মধ্যে মেজর ফারুক হোসেন ও আবদুর রশীদের লন্ডনের সানডে টাইমস-এর এন্থনি ম্যাসক্যারানহাসের সঙ্গে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য বেরিয়ে পড়ে।

এই সাক্ষাৎকারটি লন্ডনের আট টিভি থেকে সম্প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকারে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে মার্চ ৭৪ থেকে এই হত্যার একক পরিকল্পনা করে ফারুক হোসেন যখন সে (তার নিজের কথামত) একজন সাধারণ সৈনিক ছিল এবং রাষ্ট্র চালনা বা রাজনীতি সম্বন্ধে কোন জ্ঞানই তার ছিল না, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়ার জন্য সে প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ ব্যাপারে একমাত্র তার ভায়রা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুর রশীদকে অবহিত করে। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় জেনারেল জিয়ার (তখন ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ) সঙ্গে ফারুক দেখা করে এবং দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করার পর জুনিয়র অফিসারদের বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে এতে তাঁর সমর্থন ও নেতৃত্ব চায়। জুনিয়র অফিসাররা এ ধরনের পরিকল্পনা করে থাকলে তারা এগিয়ে যেতে পারে বলে জিয়া অভিমত ব্যক্ত করেন।

ফারুক জিয়ার মনের কথা বুঝতে পেরে যোগাযোগ করে খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে। সামরিক বাহিনীর আর কারো প্রত্যক্ষ সমর্থন ফারুক ও রশীদ পেয়েছিল বলে কোনো উল্লেখ এই সাক্ষাৎকারে নেই। এরপর রশীদ যোগাযোগ করে চাকরিচ্যুত সে সব জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে যাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল জাতির পিতার প্রতি।

চাকরিচ্যুত কয়েকজন জুনিয়র অফিসারকে নতুন এয়ারপোর্টে ১৪ আগস্ট রাতে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানানো হয়। তখনই তারা বঙ্গবন্ধু, সেরনিয়াবাত ও শেখ মনিকে হত্যার সিদ্বান্ত নেয়। এর আগে এই হত্যার পরিকল্পনা কাজে পরিণত করার জন্য মার্চ ১৯৭৫ থেকেই ফারুক তার ইউনিটের ট্রেনিং শুরু করে এবং প্রতি মাসে দুবার রাতে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে। এই ট্রেনিং-এ অংশ নিতো ফারুক রহমানের বেঙ্গল ল্যান্সারস এবং সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি যার অধিনায়ক ছিল রশীদ। এই ট্রেনিং এর একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেয়া। কাজেই এটাকে কোন মতেই সামরিক অভ্যুত্থান আখ্যা দেয়া যায় না।

বঙ্গবন্ধু, শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাড়িতে যে হত্যাকাণ্ড হয় তা একদিকে যেমন নৃশংস অপর দিকে তেমনি কাপুরুষচিত। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন তার মধ্যে ছিল তাঁর দশ বছর বয়সের শিশু পুত্র রাসেল, তাঁর স্ত্রী ও তাঁর দুই পুত্রবধূ, শেখ মনির গর্ভবতী স্ত্রী সেরনিয়াবাতের শিশু নাতি এবং তাঁর ছেলে, মেয়ে। রক্তপিপাসু পেশাদার খুনির পক্ষেই কেবল সম্ভব ছিল এই হত্যাকাণ্ড করা। কোনো পেশাদার সৈনিক বা সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য এই ধরনের খুন করার শিক্ষা পায় না।

দেশকে ভালোবাসতেন বলেই বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন মিলিত বাঙালির। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল তার মজ্জাগত, মানবিক চেতনায় তিনি সর্বদা ছিলেন উচ্চকিত। তিনি ছিলেন বাঙালির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির ধারক। তার কাছে সর্বদা প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের মানব-পরিচয়। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭