নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 15/08/2020
১৯৭৫ থেকে ২০২০- দীর্ঘ ৪৫ বছর পেরিয়ে আবারও এসেছে কলঙ্কময় ১৫ আগস্ট। পঁচাত্তরের এই ১৫ আগস্টেই বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করেনি, ওরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বিলীন করে দিতে চেয়েছিল। ওরা গোটা দেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করতে চেয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রই যে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল তা আজ আর কারো অজানা নয়। এই হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য যে কেবল একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা, তাই নয়, বাংলাদেশকে আবার আরেকটা পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র ছিল সেটাও আজ স্পষ্ট।
বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। সেই স্বপ্ন নিজের জন্য নয়। সমস্ত বাঙালির স্বপ্নের বোঝা কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। জাতির পিতার প্রয়াণের পর পেরিয়ে গেছে ৪৫ বছর। এই ভূখণ্ডের স্থপতিকে ছাড়া কেমন আছে বাংলাদেশ?
আমরা যদি জাতির পিতার স্বপ্নগুলোর সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা করি, তাহলে দেখবো যে, তার কিছু স্বপ্ন আজ বাস্তব। তবে অনেকগুলো স্বপ্নই এখনো অধরা রয়ে গেছে। জাতির পিতার কিছু লক্ষ্যের কাছাকাছি আমরা পৌঁছতে পেরেছি, কিন্তু সবগুলো এখনো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তার কিছু কিছু স্বপ্ন এবং লক্ষ্য অদূর ভবিষ্যতেও পূরণ করা সম্ভব হবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে, কিন্তু বৈষম্য ঘুঁচলো কই?
জাতির পিতা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি চাইতেন বিদেশের কাছে যেন হাৎ পাততে না হয়। পিতার এই স্বপ্নটা আজ বাস্তব। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়। বাংলাদেশ এখন এদেশ এখন আর বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভর করে চলে না। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় বেড়েছে। এদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় সাফল্য। তবে এর বিপরীতে ব্যর্থতাও আছে ঢের।
জাতির পিতার আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা তৈরি করা। বৈষম্য ঘোচানোর জন্যই বঙ্গবন্ধু ৭৫ এর জানুয়ারি মাসে বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। একটি সমাজতান্ত্রিক নীতি এবং আদর্শের ভিত্তিতে তিনি একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অবয়ব গড়েছিলেন। কিন্তু ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে বৈষম্য বেড়েছে। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে, দেশের বিপুল উন্নতি হচ্ছে- এর সবই সত্যি। কিন্তু উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বাড়ছে। যে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখে দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সেই বৈষম্যহীন সমাজ এখন যেন এক অলীক স্বপ্ন মাত্র। বরং বাংলাদেশে বৈষম্য বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি।
উগ্রপন্থি নই, কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ কবে হবো?
জাতির পিতার আকাঙ্ক্ষা ছিল বাংলাদেশ হবে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার- এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই বঙ্গুবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি মুক্তির সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল। জাতির পিতার একাধিক বক্তব্যেই তিনি বলে গেছেন- এই দেশ সবার, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি। এরকম একটি দর্শনই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিমূল। আমরা যদি আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে, এই জাতি মোটেই উগ্রপন্থি বা কট্টরপন্থি নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ হতে পেরেছি। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশকে ক্রমশ একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র তৈরির চক্রান্ত হয়েছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করেছিলেন। যেগুলো ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরেও জাতির পিতার নীতি এবং তার দেখানো পথে আমরা এগোতে পারিনি।
স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ, কিন্তু সমাজতন্ত্র বিলীন
জাতির পিতা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। তার সেই স্বপ্ন আজ সত্যি বলা চলে। খাদ্যশস্যে এ দেশ এখন আর কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। বর্তমানে এদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪০০ লক্ষ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। চাল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ আর আলু উৎপাদনে এদেশ অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। ফসলের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশ। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে জাতির পিতার এই স্বপ্নটা সত্যি হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি তার লক্ষ্যগুলো একটু খেয়াল করি তাহলে দেখব যে তিনি সমাজতান্ত্রিক একটি দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যে ৪টি মূল স্তম্ভ ছিল তার মধ্যে একটি ছিল সমাজতন্ত্র। ৭২ এর সংবিধানে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সমাজতন্ত্র যুক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে সেটা উপড়ে ফেলেন। বাংলাদেশকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় রূপান্তর করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার এখন টানা ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায়, এর আগেও ৫ বছর ক্ষমতায় ছিল তারা। এরপরেও পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে দেশকে সমাজবাদী তো নয়ই, একটি কল্যাণকামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকেও নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। তার কারণ হলো উগ্র পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নীতির কারণে এখন বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক নীতি এবং আদর্শগুলো পরিত্যাক্ত হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছেই, কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত দেশ আর কতদূর?
জাতির পিতা স্বপ্ন ছিল একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর তিনি বার বার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বার বার তিনি দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করার জন্য জনমত গঠনের তাগিদ দিয়েছিলেন। জাতির পিতার কন্যা আজও সেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই যেন দুর্নীতি আমাদের ছাড়ছে না। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর দুর্নীতির যে বৃক্ষরোপন করা হয়েছে, তা এখন মহীরূহ হয়েছে। কোনো সরকার চাইলে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবে না। বরং দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাংলাদেশকে এখন আমরা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার সঙ্গে তুলনা করছি। বাংলাদেশ হয়তো খুব শীঘ্রই উন্নয়ন অগ্রগতিতে এই দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র উন্নত দেশ হলেই কি জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে? উন্নত দেশ মানেই কি বৈষম্যহীন সমাজ, ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ? তা নিশ্চয়ই নয়। সেজন্যই একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, উন্নত দেশ হিসেবে একদিন ঠিকই আত্মপ্রকাশ করবে বাংলাদেশ, কিন্তু সেখানে জাতির পিতার সমস্ত স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটবে তো?
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭