ইনসাইড থট

ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে নকলে দেশ ছয়লাব!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 10/09/2020


Thumbnail

শর্টকাটে বা রাতারাতি টাকা আর খ্যাতির জন্য নকলের কী উৎসব চলছে আমাদের দেশে? চারিদিকে তেমন খবর প্রতিনিয়তই বিভিন্ন মিডিয়ায় আসছে। নাগরিক সাংবাদিকতার এই যুগে কোন কিছুই গোপন থাকছে না আর। তবুও মূল ধারার বা বহুল প্রচারিত প্রিন্ট মিডিয়া বা বহু দর্শক নন্দিত ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়া বা জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টালে নকলের সব খবর আসে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে তবেই তা চাপে পড়ে এসব মূল ধারার মিডিয়ায় প্রকাশ পায়।

ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে আর দেশের স্বার্থে নকলের প্রচলন আমরা দেখি বহুদিন ধরে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের নকল নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু খবরে জানা যায় যে, পুরাণ ঢাকার চকবাজারের মৌলভীবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার নকল বিদেশি কসমেটিক্স জব্দ করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানকালে ৫ জনকে আটকের পর প্রত্যেককে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাকওয়া এন্টারপ্রাইজ নামক একটি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে বোতল কিনে আনার পর স্থানীয়ভাবে নকল পণ্য রিফিল করে বাজারজাত করতো। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করেছে, যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জনসন শ্যাম্পু, পাউডার, ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম, লোশন, ইত্যাদির মত নামি দামি পণ্য নকল করছে প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়ে বড়লোক হবার জন্য।    

খবর বেরিয়েছে যে, “বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল টেলিমেডিসিন বিষয়ক একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে, যেটা হুবহু ভারতের টেলিমেডিসিন গাইডলাইনের নকল। ভারতের গাইডলাইনটি প্রকাশ করা হয়েছে এ বছর মার্চে। আর বাংলাদেশ ঠিক সেই একই গাইডলাইন প্রকাশ করেছে ৪ মাস পর অর্থাৎ গত জুলাইয়ে। দুটি গাইডলাইনের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্দেশনার ক্ষেত্রে রয়েছে শতভাগ সাদৃশ্য। প্রতিটি অনুচ্ছেদ এবং অনুচ্ছেদগুলোর শিরোনামও একই। অর্থাৎ ভারতের গাইডলাইনটাই নিজেদের নাম দিয়ে প্রকাশ করেছে বিএমডিসি”। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএমডিসি’র কর্মকর্তাগণ নিজেদের বিশেষজ্ঞ প্রমাণ করতে নকল নামক এই চরম বাজে উপায়ের আশ্রয় নিয়েছে, নিজেদের পরিশ্রম বাঁচাতে। নকল করার দায়ে এদের কারো জেল জরিমানার খবর জানা যায় নি।  

পিএইচডি ৯৮ ভাগ নকল করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সম্প্রতি অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ঐ শিক্ষক  হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে বলেন, তাঁর  কাছে অন্তত ৫০ শিক্ষকের তালিকা আছে, যাদের নামে প্রকাশিত গবেষণায় লাইন বাই লাইন নকল করা।  

যাই হোক, এবার দেখে নিতে পারি দেশের স্বার্থে নকলের কিছু খবর। ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে জাপানে ব্যবসার উদ্দেশ্যে যখন হুমকি দিয়ে আমেরিকার ব্লাকশিপ জাপানে নোঙ্গর করে। তারা তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থেই জাপানের অনেক অবকাঠামোর উন্নতি করলেও তৎকালীন সময়ের আধুনিক প্রযুক্তি জাপানের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। এটা বুঝতে পেরেই বাস্তবে জাপান তাদের দেশের উন্নতির জন্য অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বলতে গেলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্বর্ণকার ও কামারশালার অভিজ্ঞ লোকদের হিট ট্রিটমেন্টের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন শিল্প কারখানার যন্ত্রাংশ নকল করা শুরু করে। তখন তারা মূলত জার্মানির কাছ থেকে পাওয়া কিছু শিক্ষার আলকেই নকল করা শুরু করেন। এই নকলের উদ্দেশ্য ছিল প্রযুক্তির জ্ঞানে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলা, যাতে দেশের উন্নতি হয়, যন্ত্রাংশ আমদানির দীর্ঘ সময়ে যেন শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত না হয়। 

এভাবে যন্ত্রপাতির যন্ত্রাংশ নকল করতে করতেই জাপান দক্ষতা অর্জন করার পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে। তারা শিল্প কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নকল করলেও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, নীতি-নৈতিকতার জন্য অবক্ষয়ের হতে পারে এমন কোন কিছুই তারা করেন নি কখনো। এটা ছিল তাদের প্রচণ্ড দেশপ্রেমের কারণে। যার ফলে মাত্র ৫০ বছরের কম সময়ে জাপান প্রিথবীর অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।  

আমাদের শিল্প মন্ত্রণালয়ে অধীন ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের বিটাকের টুল এন্ড টেকনোলজি ইন্সটিটিউট (টিটিআই)। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে এরা দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভেঙ্গে যাওয়া যন্ত্রাংশ তৈরি করে থাকে। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং অর্থাৎ লেদ অপারেটরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশ জুড়ে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এটাও একধরণের নকল করা বলা যেতে পারে, যা দেশের স্বার্থে, যাতে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যাহত না হয়।  

দেশের ৩৩টি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান চলছে বিটাকের প্রশিক্ষণ পাওয়া কর্মীদের দিয়ে কারিগরি কাজ। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, নাসির গ্লাসওয়্যার অ্যান্ড টিউব, বেঙ্গল প্লাস্টিক, নিটল মোটরস, ফিলিপস, এএলএম স্টিল বিল্ডিং টেকনোলজি, শাহ সিমেন্ট, আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ডেক্কো অ্যাকসেসরিজ, বেক্সিমকো ফার্মা, ম্যাটাডোর, আবুল খায়ের গ্রুপ, ইত্যাদির মত বড় বড় শিল্প কারখানায় কাজ করছে। শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি, ফার্নিচার শিল্পেও কাজ করছেন বিটাকের শিক্ষার্থীরা যারা স্বশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত নারী, পুরুষ। এগুলোর অনেক কিছুকেই আমরা নকল বলতে পারি যা দেশের তথা আমাদের দেশের শিল্প কারখানা সচল রাখতে, নতুন শিল্পখাত উন্নয়নে কাজ করছে।     

আমাদের দেশের স্বশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত নারী, পুরুষেরা নকল (!)  করে আমাদের দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতিকে উন্নত করতে বা সচল রাখতে অবদান রাখছেন। অন্য দিকে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে নকলের মাধ্যমে পিএইচডি ডিগ্রী নিচ্ছি বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে টেলিমেডিসিন গাইডলাইনের মত কাজ করে জনগণের টাকা লুটপাট করছেন। নকল বঙ্গবন্ধু প্রেমিকেও দেশ ছয়লাব। এদের দিয়ে দেশের কী কল্যাণ হবে না দেশের জনমানুষের অর্থ পাচার হবে বিদেশে!      

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭