ইনসাইড থট

ঢাকা ও দেশের রাজনীতির বর্জ্য সমস্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 13/09/2020


Thumbnail

সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন ঢাকা তথা দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বর্জ্য নিয়ে চলছে নানান ধরনের কর্মকাণ্ড। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নগরীর বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে গৃহকরের মাত্র ৩ শতাংশ পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করলেও অথচ মহল্লাভিত্তিক স্থানীয় বাড়ি/ফ্লাট মালিক সমিতিগুলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তায় বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করার খরচ হিসেবে গড়ে খানা প্রতি ১০০ টাকার বেশি আদায় করেন, যা পরোক্ষভাবে খুচরা চাঁদাবাজি,মহল্লার সব খানার টাকা একত্রে করলে হয় একটা মোটা অংক।  যা হউক রাজনৈতিক বর্জ্যের কথা আলোচনার আগে ঢাকা মহানগরীর বর্জ্য সমস্যা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

করোনাভাইরাসের সংক্রমনের ফলে দেশে এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা ইলেকট্রনিক্স পণ্য এখন আমাদের নিত্য-ব্যবহারের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের মত পণ্যগুলো জীবনকে যতটা সহজ করছে তেমনি এগুলো ব্যবহারের কয়েক বছর পর কর্মক্ষমতা শেষে, যথাযথ আইনের অভাবে যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার কারণে আমাদের দেশ এখন ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের বর্জ্যের মারাত্মক  ঝুঁকিতে।

২০১৬ সালের এক তথ্যে বাংলাদেশে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলো বলছে দেশে প্রতিবছর ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ইলেকট্রনিক্স ওয়েস্ট বা ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। করোনায় ইলেকট্রিক পণ্যের ব্যবহার এতোই বেড়ে গেছে যে, ইলেকট্রনিক্স ওয়েস্ট বা ই-বর্জ্যের পরিমাণ এখন অনেক বেড়ে গেছে।

অন্যদিকে এবছর কোরবানি দেওয়া হয়েছে অনেক কম। তাই সারা বছর জুড়েই শহরের আনাচে কানাচে গরু জবেহ হচ্ছে অপেশাদার কসাইয়ের মাধ্যমে। কারণ করোনা কালে মানুষ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এনিম্যাল প্রোটিন খাচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এ থেকে তৈরি বর্জ্য পানি দিয়ে ধুয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, স্ট্রমওয়াটার ড্রেন বা ওয়াসার স্যুয়েরেজ লাইনে। সেখান থেকে যায় পাশের নদী খালে। এছাড়া করোনা কালে মেডিক্যাল ওয়েস্ট বেড়েছে বহুগুণ। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মেডিক্যাল বর্জ্য আলাদা করা হয় না। এছাড়া রোগাক্রান্ত পশুর বর্জ্য থেকে ছড়িয়ে পড়ছে টাইফয়েড, ডিসেন্ট্রি, ডিপথেরিয়া, anthrax, colibacilosis, giardiasis, histoplasmosis, salmonellosis, toxoplasmosis, brucellosis, Leptospirosis, listeriosis, rabies। মানে আমরা এখন চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছি। স্ট্যান্ডার্ড হলো, স্ট্রমওয়াটার ড্রেন বা স্যুয়েরেজ লাইনে যা যাবে তা হতে হয় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ তরল। তা না হলে তলানি পড়ে পড়ে স্ট্রমওয়াটার ড্রেন বা স্যুয়েরেজ লাইন আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আবর্জনার শ্রেণিভেদ নিয়ে বিতর্ক আছে। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন অনুসারে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আবর্জনাকে শ্রেণিভেদ করে নিতে পারি। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ময়লা সংগ্রহের সুবিধার্থে ময়লাকে মোটাদাগে তিনভাগে শ্রেণীবিভাগ করা হয়:

•           পৌর এলাকার আবর্জনা বা গৃহস্থালি আবর্জনা

•           বাণিজ্যিক এলাকার আবর্জনা

•           শিল্প এলাকার আবর্জনা

আবর্জনা যেখানে ফেলা হয় তাঁকে বলা হয় ল্যাণ্ডফিল, সেখানে ময়লাকে মূলত স্তরে স্তরে মাটিচাপা দেয়া হয় যার শ্রেণীবিভাগটা এরকম:  

•           পচনশীল

•           অপচনশীল বা পূণর্ব্যবহারযোগ্য

          প্লাস্টিক

          পুরাতন কাপড়

          খবরের কাগজ

          পেট-বোতল

          কাচের বোতল

          ধাতব বস্তু

•           অতিরিক্ত বড় ময়লা

•           ইলেক্ট্রনিক্স ও ইলেক্ট্রিক্যাল দ্রব্যাদি  

২০১৯ সাল শেষের দিকে ঢাকা মহানগরীতে পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুতে কর্মরত সংগঠন নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ (এনসিসিবি) পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলের কথা মিডিয়ায় এসেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় দৈনিক গড়ে ২০৬ দশমিক ২১৭ মেট্রিক টন করোনা বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, যা মাস শেষে ৬ হাজার ১৮৬ দশমিক ৫১ মেট্রিক টনে দাঁড়ায়।

বর্জ্যের পরিমাণ কমানো, বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার ও রি-সাইক্লিং সম্পদ কনজারভেশনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং এটা টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে অসংগঠিতভাবে বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার ও রি-সাইক্লিং হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে মূল্যবান দ্রব্যাদি বর্জ্য থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাদা করে বিক্রি করা হয়। ২০১৯ সালের এক হিসাবমতে ঢাকায় ১ লাখ ২০ হাজার বর্জ্য সংগ্রহকারী বর্জ্য থেকে প্রতিজন দিনে প্রায় ১৫০ টাকা আয় করেন। 

এটি তুলনামূলকভাবে সহজ ও কম ব্যয়বহুল। জৈব বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট তৈরি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। রি-সাইক্লিং ও কম্পোস্টিং করলে সবটুকু বর্জ্যই ব্যবহার করা সম্ভব। এটি কৃষিকাজ বা ছাদবাগানে ব্যবহৃত হতে পারে। যদি সরকার শহর ও গ্রামের মাঝামাঝি এ ধরনের কোনো স্টেশন বসায়, তাহলে অনেক বর্জ্য যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব।

ঢাকা ওয়াসা দাবী, তাদের স্যুয়েরেজ লাইন দিয়ে মানব বর্জ্য আর অন্যান্য বর্জ্য, সারা বছর জুড়েই বর্জ্যের একটা বিরাট অংশ মিলে শতকরা ২০ ভাগ বর্জ্য নগরীর পাশের খালে বিলে গিয়ে তা তৈরি করে দূষণের তরল মহাআধার। এর পাশাপাশি গরীব মানুষেরা পলিথিন, কাগজ, প্লাস্টিক, ইত্যাদি রিসাইকেলেবল বর্জ্য নিয়ে গেলেও কিছু রাস্তায় পড়ে থাকে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের স্ট্রম ওয়াটার ড্রেন দিয়ে শতকরা কত ভাগ বর্জ্য নগরীর পাশের খালে বিলে গিয়ে পড়ছে তার হিসাব নেই। পলিথিন, কাগজ, প্লাস্টিক, নির্মাণ সামগ্রী থেকে তৈরি আবর্জনা, ইত্যাদি স্ট্রম ওয়াটার ড্রেনে ঢুকে একটু বৃষ্টি হলেই নগরীর রাস্তায় হাঁটু পানি হয়ে যায়। ক্ষতি হয় দেশের মানুষের কোটি কোটি টাকা। ময়লা ফেলেন অসচেতন মানুষ কিন্তু দোষ হয় সিটি কর্পোরেশনের, সরকারের। যে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় সেগুলো ফেলা হয় উত্তরের আমীন বাজার আর দক্ষিণের মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে। এই কাজে দুই সিটিতে জাইকার দেওয়া ১১২ টি নতুন আর বাকী পুরাতন মিলে প্রায় ৬০০ ট্রাকের মাধ্যমে এই বর্জ্য অপসারণের চেষ্টা করে সিটি কর্পোরেশন। এর আগে মহল্লা থেকে মহল্লাভিত্তিক ঠিকাদারগণ(!) সেকেন্ডারি ট্র্যান্সফার স্টেশনে নিয়ে আসেন। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে কয়েক বছরেই ল্যান্ডফিল দুটো প্রায় ভরে গেছে, নতুন দুটি জায়গা খুঁজতে হবে।

১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ‘বিপ্লবে পরিপূর্ণতা প্রদান ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার স্লোগানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)এর আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এর পরেই দেশ ছেড়ে পালাতে না পারা রাজাকার, আলবদর, আল শামস, স্বাধীনতা বিরোধী চৈনিক বামেরা গ্রেফতার এড়াতে দলে দলে প্রধানত জাসদে আর অন্যান্য বাম দলে যোগ দেয়। জাসদে মুজিব বাহিনী,  মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ জাসদের কাতারে এসে শামিল হলেও জাসদে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা ছিল ৫০ ভাগের অনেক বেশি।

গণবাহিনী গঠিত হয় ‘৭৪ সালে। ’৭৪-এর ১৭ মার্চ। থানা, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর ক্যাম্পসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন আক্রমণ। ফলে সারা দেশে গোলাম কিবরিয়া ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি বড় জামে মসজিদ ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজরত অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ছাড়াও ময়মনসিংহ সহ সারাদেশে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের এমপিকে হত্যা করা হয়। যার দায় গিয়ে পড়ে অনুপ্রবেশকারী জাসদের উপর।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পরে জাসদের সুবিধাবাদী অনুপ্রবেশকারীরা দল ত্যাগ করে নিজ নিজ প্রাক্তন দল আর সরকারী দলে যোগ দেয়। কারণ তারা নিজেদেরকে জাসদে আবর্জনা বা বর্জ্য মনে করতেন। জিয়া সরকারের পতনের পরে এরা অনেকেই জাতীয় পার্টিতেও যোগ দেন। আর ২০০৭-৮ এর পরে বহুগামী এসব ‘রাজনৈতিক বেশ্যা’দের একটা বিরাট অংশ এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের উপর ভর করে পালে পালে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ে নিজেদের নিরাপত্তা আর অপকর্মের মাধ্যমে টাকা আয়ের জন্য। এতে আওয়ামী লীগে থাকা খন্দকার মোস্তাক বা তাহের ঠাকুরেরা করেন সহযোগিতা। এর ফলে মাত্র ১ যুগের মধ্যেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তাঁর সহযোগী সংগঠনগুলো একটি রাজনৈতিক বর্জ্যের ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত হয়ে পড়েছে। এসব বর্জ্যের মাঝে কিছু বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও রি-সাইক্লিং করার মত পাওয়া গেলেও তা সার্বিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য হয়ে উঠেছে মারাত্মক ক্ষতির কারণ।         

যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লিগ, যুব মহিলা লীগ সহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের জেলা উপজেলা, ইউনিয়ন মহল্লা কমিটিতে ব্যাপক পদ ও কিমিটি বাণিজ্যের ঢালাও অভিযোগ আসার পরে যুব মহিলা লীগ বাদে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। রাজনৈতিক বর্জ্যরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পদ পদবী বা কমিটি অনুমোদন নেওয়ার পরে টাকা উসুল করতে নানা অপরাধ ও অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়েছে সারা দেশ জুড়ে। এরা মুজিব কোর্ট ব্যবহার করে ক্যাসিনোর কেলেংকারীর হোতা বা পাপিয়া, সাহেদ বা হালের শিশু অপহরণকারীদের মত স্থানীয় মিডিয়া কর্মীদের অধিকাংশকে হয় টাকার বিনিময়ে অথবা ভয় ভীতি দেখিয়ে এসব অপকর্মের খবর প্রকাশ হতে দেয় না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি কিছুই জানতে পারে না। ফলে সব দোষ এসে পড়ে সরকারী দল তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপর।      

পুনর্ব্যবহার ও রি-সাইক্লিং করার উপযোগী অনুপ্রবেশকারীদের বাদ দিয়ে দুর্গন্ধ ছড়ানো ক্ষতিকর রাজনৈতিক বর্জ্যকে এখনি বর্জ্যের ল্যাণ্ডফিলে মাটি চাপা দেওয়া দরকার। তা না হলে এরা পচবে, পচাবে, ছড়াবে নানা ধরণের দুর্গন্ধ সহ রাজনৈতিক অসুখ। দেশের উন্নয়ন হবে ব্যাহত, দেশের সাধারণ মানুষের জীবন হবে অতিষ্ঠ।  

লেখক: কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭