ইনসাইড থট

ভ্যাকসিন নিয়ে কথকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 13/09/2020


Thumbnail

চীনে কোভিড-১৯ অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে যখন বিজ্ঞানীরা প্রথম জানতে পারলো, তখন থেকেই বিভিন্ন নামকরা বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য রাত দিন কাজ করতে শুরু করে। কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যে শর্টকাট পথটা গ্রহণ করা হয়, তা হলো পূর্বে বিভিন্ন ভাইরাসের আক্রমণের প্রেক্ষিতে যেসব ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছিল, সেই টেকনোলজি থেকেই কোভিড- ১৯ এর ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সারা বিশ্বে ১৪০টির উপরে করোনা ভ্যাকসিন তৈরির কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। তবে তার মধ্যে মানব দেহে প্রয়োগ শুরু করার মতো অবস্থানে আছে, ৮ থেকে ১৪টি ভ্যাকসিন। ইতিমধ্যে রাশিয়া তাদের একটি ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে গেছে ঘোষণা দিয়ে সেটার বাজারজাতকরনও শুরু করেছে। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে যে ৭৬ জন মানুষের উপরে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চালিয়েছিল, তার ফলাফল বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এই ল্যানসেটে প্রকাশিত হওয়ার পরে বিশ্বের ৪৮ জন নামকরা বিজ্ঞানী সেই ভ্যাকসিনের কিছু দুর্বলতা তুলে ধরেছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে এই রাশিয়ান ভ্যাকসিন সেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি। কারণ তাহলে ল্যানসেটকে তাদের নিবন্ধ প্রত্যাহার করতে হতো, যেমনটা অ্যান্টি ম্যালেরিয়াল ড্রাগের ক্ষেত্রে অতীতে ঘটেছিল।

অন্যদিকে চীনও তাদের একটি কোম্পানির ভ্যাকসিন বাজারজাত করছে, যেটার নাম হলো সাইনোভ্যাক। তাদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশেও খুব শীঘ্রই আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলছে। প্রায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার লোকের ওপর এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চালানো হচ্ছে। ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে একজন ভ্যাকসিন গ্রহীতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থতার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য মানুষকে জানানো হয়নি। তবে স্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি এ ব্যাপারে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর পরে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল আবার শুরু হয়েছে। সুতরাং এ নিয়ে দুশ্চিন্তার আর তেমন কোনো কারণ নেই।

ভ্যাকসিন মূলত দুই ভাবে তৈরি হয়। একটা হচ্ছে, মৃত ভাইরাস দ্বারা ভ্যাকসিন তৈরি করা, আরেকটি হচ্ছে কেমিক্যাল দ্বারা ভ্যাকসিন তৈরি করা। সব ভ্যাকসিনেরই লক্ষ্য হচ্ছে, সুস্থ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করা। এর কাজ হলো আমাদের টি সেল, যেটা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, সেই টি সেলকে শক্তিশালী করা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা।

ভ্যাকসিন যারা তৈরি করেন, তাদের জন্য এবং সাধারণ মানুষের জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে, ভ্যাকসিনটির কোনো সাইড ইফেক্ট আছে কিনা। অর্থাৎ এর মাধ্যমে মানুষের কোনো ক্ষতি হবে কিনা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, এর কার্যকারীতা। কার্যকারীতার সাথে সাথে প্রশ্ন ওঠে যে, কার্যকারীতা কতদিন থাকবে।

আমাদের জন্য সবচেয়ে আশার কথা হলো, বাংলাদেশে গ্লোব বায়োটেক নামে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ কোম্পানিও এই কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করছে। তারা আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে এই ভ্যাকিসিনটি বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) কাছে জমা দেবে বলে আমরা জেনেছি। আমাদের কাছে তাদের আবেদন এলে আমরা যাচাই বাছাই করে তাদের ভ্যাকসিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। যদিও আমরা আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে আনঅফিসিয়ালি জানতে পেরেছি যে, গ্লোব বায়োটেক এনিমেল ট্রায়াল শেষ করেছে। তাদের ডাটা সম্পূর্ণ হলেই তারা আইসিডিডিআরবি’র কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করবে। আন্তর্জাতিক জার্নালেও তারা এটা প্রকাশের জন্য দেবে। আইসিডিডিআরবি যদি মনে করে ভ্যাকসিনটি বিএমআরসি’র কাছে পাঠানোর মতো, তাহলে সেটা আমাদের কাছে পাঠাবে।

একটি বিষয় সবার মনে রাখা দরকার যে, যত সময় পর্যন্ত ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে প্রয়োগ করার জন্য ছাড়পত্র দেওয়া না হয়, তত সময় পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিনই আলোর মুখ দেখে না। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ট্রায়াল চালানোর পরেও একটি রোগীর জন্য অক্সফোর্ডের ট্রায়ালটা বন্ধ রাখতে হলো। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ভ্যাকসিন কতটা স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এখন পর্যন্ত যেসব ডাটা আমরা পাচ্ছি, তাতে এখন পর্যন্ত মানবদেহে বড় আকারে কোভিড-১৯ বা করোনা ঠেকাবার জন্য কোনো ভ্যাকসিন পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত নয়। রাশিয়া এবং চীন তাদের ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু করলেও সেটা এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি।

যতদূর জানা যাচ্ছে, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন মাসের দিকে সাধারণ মানুষের জন্যে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। আর ডিসেম্বর জানুয়ারি থেকে হয়তো নিয়ন্ত্রিতভাবে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হবে। একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, যেকোনো ভাইরাসে বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর মতো একটি প্রানঘাতী ভাইরাসের ক্ষেত্রে যত সময় পর্যন্ত ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া যাবে, তত সময় পর্যন্ত এই রোগ থেকে আমাদের সার্বিকভাবে রক্ষার উপায় নাই। একমাত্র মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, এবং সামাজিক দূরত্বের মাধ্যমে আমরা এটাকে প্রতিরোধ করতে পারি। আর ভ্যাকসিন যখন মানবদেহে প্রয়োগ শুরু হবে তখনও আমাদের এই নিয়মগুলো কিছুদিন পর্যন্ত মানতে হবে। অনেকে হয়তো মনে করেন যে, ভ্যাকসিন পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের আর মাস্ক পরা লাগবে না, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে না। এ ধারণা সঠিক নয়, কারণ ভ্যাকসিন রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করতে একটা নির্দিষ্ট সময় লাগবে।

আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশের ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে অনেকেই নানা রকম প্রশ্ন তুলছেন। তবে আমি মনে করি, জননেত্রী শেখ হাসিনার কূটনীতির কারণে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে সঠিক পথেই আছে। বাংলাদেশ সঠিক সময়েই ভ্যাকসিন পাবে। এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। 

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭