ইনসাইড আর্টিকেল

বিহারী: বংশ পরম্পরায় পাপের বোঝা বইছে যারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/09/2020


Thumbnail

বিহারী। তিন অক্ষরের এই ছোট্ট শব্দটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক কৌতূহল, অনেক শঙ্কা, কখনো বা বিদ্বেষ। কিন্তু কারা এই বিহারীরা? কিভাবে, আর কেনই বা তারা এই দেশে এলো? আর এলো যখন, কেমন আছে এই মানুষগুলো? এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমাদের আজকের আয়োজন।

বিহারী শব্দের আক্ষরিক অর্থ “বিহারের মানুষ।“ কিন্তু বাংলাদেশে উর্দুভাষী সকলকেই আমরা বিহারী বলে থাকি। বাংলাদেশের প্রায় ১৩টি অঞ্চলে ৬৬টি ক্যাম্পে আনুমানিক ৩ থেকে ৫ লক্ষ বিহারীর বসবাস। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় প্রথমবারের মতো বিহারিরা বাস্তুহারা হয়। প্রায় দশ লক্ষ উর্দুভাষী মুসলিম সেসময় ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থিতু হয়। কারন? ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং “ইসলামিক জীবনধারা” মেনে চলা যেন সহজ হয়। একারণেই পাকিস্তানের প্রতি বিহারীদের আনুগত্য প্রথম থেকেই ছিল চোখে পড়ার মতো।

তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা কখনোই বাঙ্গালীদের বিশ্বাস করেনি। শাসকগোষ্ঠীর ধারণা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ হল সেমি হিন্দু, প্রো-ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের প্রতি অননুগত, যারা তাদের বাঙ্গালিয়ানা ত্যাগ না করা পর্যন্ত পরিপূর্ণ মুসলিম হয়ে উঠতে পারবে না। তাই যে ২৪ বছর বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনে ছিল, এর পুরোটা সময় জুড়েই বাঙ্গালীরা ছিল ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার। সরকারি চাকুরি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিহারীরা, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী ছিল সরকারের কাছে বাঞ্ছনীয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিহারীদের প্রতি বাঙ্গালীদের মনে এক ধরণের বিতৃষ্ণার জন্ম নেয়। সেই বিতৃষ্ণা প্রকট আকার ধারণ করে যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারীরা পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ না নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে।

কিন্তু পাকিস্তানী নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও এই বিপুলসংখ্যক বিহারীকে ফিরিয়ে নিলো না কেন পাকিস্তান? কারণ পাকিস্তানি সরকারের ভয় ছিলো এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া কেবল ব্যয়বহুল নয়, বরং বিবাদেরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও বিহারীদের পাকিস্তানে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়ায় পাকিস্তানি নাগরিকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে সকল পরিকল্পনা থমকে দাঁড়ায়। ফলাফলঃ পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৭০,০০০ বিহারীকে ফিরিয়ে নিলেও বাকিরা এদেশে আটকা পড়ে যায়।

কেমন আছে এই আটকে পড়া বিহারী জনগণ? ছোট উত্তর- ভালো নেই।

স্বাধীনতার পরপরই বিহারীদের ঘিরে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ- কোনকিছুর হাত থেকেই রেহাই পায়নি বিহারীরা।  এই রাহাজানি চলেছে দিনের পর দিন- ঝিনাইদহের তৎকালীন পুলিশ সুপার এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “these bastard Biharis – we’ve got a lot to kill” (Gerlach, 2010:150)”। নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পেতে বিহারীরা আশ্রয় নেয় বিভিন্ন ক্যাম্পে, এবং গত ৪০ বছর ধরে তারা ক্যাম্পের পরিসরেই সীমাবদ্ধ। তাদের প্রতি নৃশংসতা কমে আসলেও থেমে যায়নি পুরোপুরি। মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ  ইন্টারন্যাশনালের তথ্যানুযায়ী এখনো যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিহারিদের উপর অত্যাচার চলে।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকার বিহারীদের একাংশকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দান করলেও প্রতিনিয়ত বিহারীরা হচ্ছে বৈষম্যের স্বীকার। শিক্ষাক্ষেত্র বা কর্মজীবন - যেকোন জায়গায়ই বিহারীদের নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হয়। যদিও ১৮-২৫ বছর বয়সী বিহারীদের অধিকাংশই  বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ হিসেবে বিশ্বাস করে, তবুও শুধুমাত্র ক্যাম্পে জন্মগ্রহণ করবার অপরাধে সকল নাগরিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। তাই বিহারীরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে অশিক্ষা, দারিদ্রসহ আরো বিভিন্ন প্রকার সমস্যার সাথে। নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও কেবল জন্মপরিচয়ের কারণে বিহারীদের এই সংগ্রাম আমাদেরকে এই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়- সাম্প্রদায়িকতা থেকে কি তাহলে মুক্তি নেই? যদিও এই কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে বিহারীদের একাংশ যুদ্ধাপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু ব্যক্তির অপরাধ সমগ্র জনগোষ্ঠীর উপর আরোপ করাটা কোন যুক্তি কিংবা মানবিক বোধের যায়গায়  গ্রহণযোগ্য ? কিন্তু বংশ পরম্পরায় বিহারীরা তাই বহন করে চলেছে ৪৬ বছর ধরে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পুরুষদের একটি ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল গুনছে বর্তমান এই প্রজন্ম। যারা কিনা জন্ম সুত্রে এখন এ দেশের নাগরিক। জন্ম সুত্রে নাগরিক হয়া সত্তেও তারা বর্তমানে যে মানবেতর জীবন যাপন করছে তাতে কি কোন ভাবেই তাদেরকে এদেশের নাগরিক বলা চলে ?

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭