ইনসাইড আর্টিকেল

যুদ্ধ, জাতিগত নির্মূলতা ও গালি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/09/2020


Thumbnail

যুদ্ধ, শব্দটি শুনলেই আমাদের কেমন যেন গা শিউরে ওঠে। সেই মানব সভ্যতার শুরুতে  ছোট ছোট গোত্রের লড়াই থেকে শুরু করে  আজকে ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিতে চলা যুদ্ধ যেন মানব সভ্যতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একটি বৈশ্বিক যুদ্ধ যা ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ইউরোপে শুরু হয় এবং ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই যুদ্ধে ৯০ লক্ষ যোদ্ধা ও ১ কোটি ২০ লক্ষ  নিরীহ মানুষ নিহত হয়। প্রায় ১ কোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লক্ষ সাধারণ মানুষ আহত হয়।

 তেমনি ভাবে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। কুখ্যাত এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম যুদ্ধ। 

এছাড়াও ধর্মীয় প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কারণে যুদ্ধ,  ভৌগলিক অবস্থানের কারণে দেশ দখলের যুদ্ধ, খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য ক্ষমতাধর দেশ গুলর তুলনা মুলক কম খমতাধর দেশ গুলর সাথে যুদ্ধ সহ আর বিভিন্ন কারণে এক দেশের সাথে আর এক দেশের যুদ্ধ লেগেই আছে আমাদের এই পৃথিবীতে। এর  ফলে লক্ষ কোটি মানুষ হারাচ্ছে প্রান আর সেই সাথে হচ্ছে দেশান্তরী । এবং এই পৃথিবী থেকে  নির্মূল হয়ে যাচ্ছে অনেক জাতি । এবং পরিনত হচ্ছে  গালিত, কীভাবে?   

 

   আপনি যদি রাস্তায় নিয়মিত গণপরিবহনে যাতায়াত করে থাকেন, সেক্ষেত্রে বাসের হেল্পার কিংবা রিকশাওয়ালাদেরকে একে অপরকে গালাগাল করতে দেখাটা আপনার জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আপনি যদি একটু ভালভাবে  লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন - ইদানিং এদের মাঝে গালি হিসেবে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । কখনো কি আপনি ভেবেছেন এর কারণটা কি ?

   ‘রোহিঙ্গা’ কারা ? রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি ইন্দো-আরিয়ান জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের রয়েছে বেশ পুরনো ইতিহাস। অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত মিয়ানমারে  ইতিহাসে রোহিঙ্গাদের সন্ধান পাওয়া যায় । এমনকি ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত মিয়ানমারে ১১ থেকে ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাস করত । কিন্তু, মিয়ানমারের সরকার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে এবং ৭০ দশক থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা নিপীড়িত হয়ে আসছে।

 

২০১৭ সালে আরাকান রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাকামী জঙ্গিদের আক্রমণে সে দেশের ১২জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হওয়ার পর মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘ক্লিয়ারেন্স’ অপারেশন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শরণার্থী হিসেবে এদেশে পালিয়ে আসা শুরু করে । সুত্রমতে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে । জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ দমন- পীড়নকে জাতিগত নির্মূলতা বা এথনিক ক্লিনসিং হিসেবে আখ্যা দিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত ও নাজুক সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করেছে। এমনিতেই বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। একারণে এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা  শরণার্থীদের কে অনেকেই একটি বিরাট ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন । অনেকে মনে করেন, এর ফলে আমাদের দেশে বিরাট নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কিন্তু, শরণার্থী সংকট বাংলাদেশে এটাই প্রথম নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনির  আক্রমণে পর  প্রায় এক কোটি বাঙালি, শরণার্থী হিসেবে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকার এবং জনগণ সে সময়ে বেশ সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিল । বাঙ্গালীদের জন্য সে সময়  ভারতের ৭টি রাজ্যে মোট ৮২৫টি শরণার্থী শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল । আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষের চাহিদার জোগান দিতে ভারত সরকার বিরাট চ্যালঞ্জের সম্মুখীন হয়। কিন্তু আপনি কি বলতে পারবেন ভারতের জনগণ কখনো আমাদেরকে অর্থাৎ বাঙ্গালিদেরকে,” বাঙালি “ বা বাংলাদেশি বলে  গালি দিয়েছিলো ...? না দেয়নি। রোহিঙ্গাদের আজকের অবস্থানের সাথে আমাদের ৭১ সালে শরণার্থী হওয়ার অনেক মিল রয়েছে। সে সময়ে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র সাত লাখ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে আশ্রয় নেওয়ার পর , আপনিই বলুন আমাদের কি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত ? মজার ব্যাপার হল, যেখানে নিপীড়কদের ঘৃণা দেখানো উচিত ছিল সেখানে এই নিপীড়িত রোহিঙ্গারাই হয়ে গেল গালি.

  প্রতিটি মানুষের কাছেই তার নিজের দেশ আস্থার জায়গা, আর রোহিঙ্গাদের কাছে সেই দেশ-ই হয়ে উঠেছে মৃত্যুকূপ। হয় মরো নয়তো দেশ ছেড়ে পালাও। বাংলাদেশে তাদের প্রবেশ স্বেচ্ছাকৃত নয় বরং তারা বাধ্য হয়েই এসেছে আমাদের দেশে জীবন বাঁচানোর জন্য । নিজেদের অতীত ছেড়ে আসা এসব রোহিঙ্গারা এখনো স্বপ্ন দেখে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে আর তারা ফিরে যাবে নিজের জন্মভুমিতে । 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭