নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 17/09/2020
করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। এডিবির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উৎপাদনের গতি বাড়ায় এবং বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতা দেশগুলোতে ভোগের পরিমান বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে বলেও প্রাক্কলণ করেছে তারা। এসব বিষয়ে বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ড. আতিউর রহমান বলেন, মহামারীর ধাক্কা সামলেও বাংলাদেশ বেশ ভালো ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে।এর পেছনের বড় একটি কারণ হিসেবে বর্তমান সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুরু থেকেই এক ধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের বিষয়টিকে চিহ্নিত করেন।১৯৯৬ সালে প্রথম বার সরকার পরিচালনায় এসে তিনি এই কৌশল নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। আর ২০০৮-এ দিনবদলের যে সনদ তিনি দিলেন, সেখানে মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করবার কৌশলটি আরও স্পষ্ট করে গ্রহণ করেছিলেন। এর সাথে যুক্ত করেছিলেন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি।এই গনমুখি কৌশলটি এখনও সরকার অনুসরণ করে চলেছে।এটিই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। একই সঙ্গে ম্যাক্রেঅর্থনেতিক স্হিতিশীলতা বজায় রেখে ব্যাবসা-বানিজ্যের জন্য উদ্দীপনামূলক পরিবেশ ধরে রেখেছে। তবে এ সম্পর্কিত নিয়ম-নীতি সহজতর করা গেলে ব্যাবসায়ী পরিবেশের আরও উন্নতি করা সম্ভব।
বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির দ্বিতীয় কারণ হলো কর্মসংস্থান সৃজন।মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সরকার আধুনিক রপ্তানি-নির্ভর শিল্পায়নের ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছে।সেজন্য নানা মাত্রিক নীতি সহায়তা দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে।তৃতীয় কারণ হলো আমাদের সচল কৃষিখাত যা দিন দিন আরও আধুনিক হচ্ছে।এই জায়গাটাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময়ই গুরুত্ব দিয়েছেন।এ খাতে তিনি ফি বছর সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়েছন। ব্যাক্তি খাতও যাতে এতে বিনিয়োগ বাড়ায় সেজন্য রাজস্ব প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছেন। আলাদা কৃষিঋণ নীতিমালা চালু করে এখাতে অর্থের প্রবাহ বাড়িয়েছেন। সরবরাহ চেইন মজবুত করেছেন। লজিষ্টিক্স সমর্থন বাড়িয়েছেন।কৃষি এখন আর শুধুমাত্র ফসল বোঝায় না। পোলট্রি, মৎস্য, গরুর খামার, সব্জি, এগুলোও কৃষির মধ্যে পড়ে। এই প্রতিটি বিষয়েই যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকার। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। আমরা যে গ্রামীন অর্থনীতিতে এত ভালো করছি তার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে, আমাদের টাকা দ্রুত শহর থেকে গ্রামে যেতে পারছে। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে শুধুমোবাইল ব্যংকিং এর মাধ্যমে। এর সঙ্গে যদি এজেন্ট ব্যংকিং যুক্ত হয়, তাহলে একটা বড় অংকের টাকা আমাদের দেশের মধ্যেই লেনদেন হচ্ছে। সরকারও শিক্ষা বৃত্তি, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির টাকাও ডিজিটাল আর্থিক সেবার মাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেছে।আর এর সাথে যুক্ত হচ্ছে বাড়ন্ত প্রবাস আয়। এই টাকাগুলো গ্রামে গিয়ে নিশ্চয় এক জায়গায় বসে থাকে না। এই টাকা দিয়েই সেখানে নানা ধরনের বিনিয়োগ হয়। এ রকম একটা বহুমুখী বিনিয়োগ প্রক্রিয়া আমাদের গ্রামের মধ্যে চলছে। যার কারণে গ্রামের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্রামে ভোগের, গ্রামের মধ্যে চাহিদা তৈরি হচ্ছে। গ্রামের প্রচুর মানুষ এখন শ্যাম্পু, টুথ ব্রাশ ব্যবহার করে। সেখানে এগুলোর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। সেই চাহিদা আমাদের শিল্প পন্যের বাজার বাড়াচ্ছে।এভাবেই আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বাড়ছে। বাড়ন্ত অর্থনীতিরএই ভিত্তিটা তৈরি করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল। আমাদের বিদ্যুৎ খাতও এক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। অনেক বিনিয়োগই আমরা এক সময় করতে পারিনি বিদ্যুতের অভাবে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার একটা বড় রকমের সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে।তবে এক্ষেত্রে সবুজ উদ্যোগকে উৎসাহিত করার প্রয়োজন রয়েছে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক খাতের আরেকটি সাফল্য হলো রেমিট্যান্স। এরকম একটা মহামারীর সময়েও আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ কাজ করছে। একটা কারণ হলো সরকার এই খাতে ২ শতাংশ করে প্রণোদনা দিয়েছে। আরেকটা কারণ হলো মোবাইল ব্যংকিংয়ের কারণে টাকাটা খুব দ্রুত পৌঁছে উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।তিন নম্বর কারণ হলো, টাকাগুলো খুব স্বচ্ছভাবে এখন আসছে। আগে টাকাগুলোর একটা অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসতো। এখন প্রায় পুরোটাই ব্যংকিংয়ের মাধ্যমে আসছে। আর আগেই বলেছি ব্যংকিং সেবাটাও খুব দ্রুত সস্তায় মানুষ পাচ্ছে। দেশে প্রশাসনিক এবং আর্থিক খাতের ব্যাপক ডিজিটাল রুপান্তরের ফসল আমরা এখন ঘরে তুলতে পারছি।এসব কারণে রেমিট্যান্স বেশি আসছে। আর রেমিট্যান্স বেশি আসলে সেটা গ্রামে চলে যায়। টাকা গ্রামে গেলে চাহিদা তৈরি হয়। একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে রেমিট্যান্স চলে যাচ্ছে। আগে মানুষ টাকা পেলেই বাড়ি বানাতো। এখন তারা আর সেটা করে না। কোনো না কোনো কাজে টাকাটা বিনিয়োগ করে। এসব কারণে গ্রামগুলো অর্থনৈতিকভাবে বেশ চাঙা আছে।
প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে ড. আতিউর বলেন, যে প্রবৃদ্ধির কথা এডিবি বলছে এর চেয়েও তো আমাদের প্রবৃদ্ধি বেশি হতে পারে। অর্থনীতির যে ব্যাপক ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ঘটে গেছে তার যে আউটকাম সে হিসেব তো আমরা এখনও ধরতে পারছি না। যেমন- আমাদের ই-কমার্সে কত মানুষ কাজ করছে, কতো নয়া ডিজিটাল উদ্যোক্তা আছে, কতো ফ্রি লান্সার আছে, তারা কত আয় করছে, এগুলোর পূর্নাংগ হিসেব কিন্তু আমরা বিবিএস এর হিসেব থেকে পাচ্ছি না। সুতরাং এগুলো যদি ধরি, তাহলে প্রবৃদ্ধির হার হয়তো আরও বৃদ্ধি হতে পারে। আমার মনে হয় যে, প্রবৃদ্ধি হার কত হলো, সেই আলাপে না গিয়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি কেন আশেপাশের দেশের থেকে ভালো তা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি। আগেই বলেছি অনেক ক্ষেত্রে আমরা অনেক দেশের চেয়ে ভালো করছি।এক নম্বর আমরা কৃষিতে গুরুত্ব দিয়েছি, দুই নম্বর আমরা রেমিট্যান্সে গুরুত্ব দিয়েছি। তিন নম্বর আমরা গার্মেন্টস শিল্প তথা উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। চার নম্বর আমরা বিদ্যুৎ খাতে ভালো করেছি। আরেকটা কাজ আমরা করছি, তা হলো- আমরা অবকাঠামো খাতে বিনয়োগ করেছি। বিশষ করে,বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শুরু করেছি।এসবে ভবিষ্যতে অনেক বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হবে। দেশি বিদেশি দুই ধরনের বিনিয়োগই এক্ষেত্রে আসবে। আর অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো যদি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে।চীন থেকে সরে আসা অনেক উদ্যোক্তাকেই আমরা আকর্ষণ করতে পারবো।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক একটা ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে বহির্বিশ্বে। এ কারণেও অনেক বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে আসবে। সব জায়গাতেই বাংলাদেশকে নিয়ে একটা আশাবাদ তৈরি হয়েছে। এটাকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে।আমাদের সাফল্যের গল্পগুলো পেশাদারি ভাষায় দেশে ও বিদেশে চৌকস ভাবে বলতে হবে।এই যে মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ‘আরেক বাংলাদেশ’ সেই কথাগুলো আরও আকর্ষনীয় ভাবে তুলে ধরতে হবে সর্বত্র।
সবশেষে তিনি বলেন এ বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পৃথিবীর সেরা হতে পারে। সেজন্য আমাদের অর্থনৈতিক প্রণোদনার কর্মসূচি গুলোর বাস্তবায়ন যাতে সঠিক ভাবে সবার জন্য হয় তা ডিজিটালি মনিটরিং করে যেতে হবে। শিক্ষা( বিশেষ করে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ), জনস্বাস্হ্য, সামাজিক সুরক্ষা, ডিজিটাল রুপান্তর (তথা ই-সরকার,ই-শিক্ষা, বাড়ি থেকে কাজ করা),জলবায়ু সহায়ক কম-কার্বন নি:স্বরন ধর্মী টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য স্মার্ট বিনয়োগ করার পথ ধরে হাঁটলে নিশ্চয় আমরা পুরো পৃথিবিকে এই করোনা সংকট কালেও অবাক করে দিতে পারবো। এমন একটি আশাবাদী সামাজিক পরিবেশ বজায় থাকুক সেই প্রত্যাশাই করছি।দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের দিকে নজরটা যেন সর্বদাই বজায় থাকে সেই কামনা করছি।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭