কালার ইনসাইড

ওটিটি প্ল্যাটফর্মঃ বৈশ্বিক বিনোদন বাজার (পর্ব–১)

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/09/2020


Thumbnail

 

চলুন একটা হিসেবের গল্প করে ফেলি! কল্পনা করি নিশ্চিন্তপুর নামক একটি অঞ্চলে ২০ ঘর বাসিন্দার বসবাস। তাদের আছে আলাদা রূপ, আলাদা সংস্কৃতি আর আলাদা ভাষা। তারা একদা চিন্তা করলো তারা তাদের ওই অঞ্চলের গল্প নিয়ে একটি সিনেমা বানাবে। সেই সিনেমা বানাবার পর ওই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র বিনোদনের স্থান সিনেমা হলটিতে তারা সেই সিনেমা মুক্তি দিয়ে সবাই মিলে দেখবে। যেই কথা সেই কাজ, ওই অঞ্চলের সংস্কৃতি আর অসাধারণ গল্পের মিশ্রণে তৈরী হলো সিনেমার গল্প। পরিকল্পনা মতো শুটিং শেষ করা হলো। সিনেমার নির্মাতা একটি নির্দিষ্ট দিনে ওই অঞ্চলের সবাইকে দাওয়াত করলেন সিনেমা দেখতে। অবশেষে নির্মাতার ঘোষিত দিন তারিখে মুক্তি পেল অসাধারণ সেই সিনেমাটি। অসাধারণ গল্প আর নির্মাতার মুন্সিয়ানায় সিনেমা দেখতে আসা দর্শকেরা খুবই খুশী।

এবার হিসাবের খাতা খুলে বসলেন সিনেমার নির্মাতা, তার ইচ্ছা ছিলো ওই অঞ্ছলের বাসিন্দাদের সিনেমা দেখানোর বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ দিয়েই সিনেমা নির্মাণের খরচ উঠিয়ে আনার। তার হিসাব অনুযায়ী যতজন লোক সিনেমা দেখতে আসার কথা সেই হিসাব মিলছিলো না, কারণ অনেকের ব্যস্ততা বা অন্য কাজ থাকায় আসতে পারেননি নির্মাতার অসাধারণ সিনেমাটি দেখতে। অন্যদিকে সিনেমার শো থেকে বঞ্চিত হওয়া দর্শকদেরও আফসোস থেকে গেলো সিনেমাটি না দেখতে পেরে। ফলস্বরূপ অনেক মানুষ বঞ্চিত হলেন অসাধারণ সিনেমাটি দেখা থেকে আর সেই নির্মাতা বঞ্চিত হলেন তার লগ্নি করা টাকা উঠে আসা থেকেও।

একজন সিনেমা প্রডিউসার সিনেমার পেছনে টাকা লগ্নি করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারনের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে একটি ভালো সিনেমা নির্মাণ করার পরে সেই সিনেমাটিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং সেটি থেকে টাকা উপার্জন করা। সেই কারণেই একজন সিনেমা নির্মাতা বা একজন সিনেমার প্রডিউসার এর প্রথম ভাবনা থাকে তার নির্মিত সিনেমাটি কোথায় কিভাবে মুক্তি দিবেন এবং সেটি থেকে লভ্যাংশ ঘরে তুলবেন।

ধরুন একটা দেশে মোট ১২০০ সিনেমা হল আছে, এখন যদি সিনেমার বাজেট এমন হয় যে একজন প্রডিউসার যে টাকা লগ্নি করলেন ১২০০ সিনেমা হলে রিলিজের পরেও লাভের মুখ দেখা সম্ভব নয় তখন অবশ্যই তাকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। একজন লগ্নিকারক তখনই বড় বাজেটের সিনেমায় টাকা ঢালতে পারবেন যখন সিনেমার বাজার বড় হবে। আর সিনেমার বাজার তখনই খুব বড় হবে যখন আপনি গোটা বিশ্ববাজারকেই আপনার বাজার হিসাবে বিবেচনায় নেবার মতো সক্ষমতা রাখবেন। এবার আসি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের গল্পে! ওটিটি হচ্ছে ওভার দ্যা টপ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ।

বর্তমান বিনোদন দুনিয়ায় একটি পরিচিত ও একইসাথে আলোচিত শব্দ। ওটিটির আলোচনার আগে আরেকটি আলোচনা করে আসি চলুন। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে দেশে দেশে বদলেছে অনেক কিছুই। নব্বই পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক শব্দটির প্রচলন হতে শুরু করে বেশ। মুক্ত বাজার অর্থনীতি আর সংস্কৃতির বাউন্ডারি টপকানোর সাহস আর উৎসাহ জুগিয়েছিলো রাষ্ট্রই। সেই প্রেক্ষাপট থেকেই বিশ্ব সিনেমা আর বিনোদন বাজার গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিলো দেশে দেশে। ওই সময়টা থেকেই সিনেমা হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্রেও। হলিউড, বলিউড, রাশিয়া, কোরিয়ান কিংবা চাইনিজ সিনেমা শুধুমাত্র নিজের দেশের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন বোধ করলো। কেবল সংযোগের সময়ে গণ্ডী পার হলেও মানুষের আলাদা আলাদা রুচির জন্য আলাদা আলাদা কন্টেন্ট এর চাহিদা তখনো পূরণ হচ্ছিলো না।

এরপর ইন্টারনেট যুগের আগমনে সেই পালে হাওয়া লাগলো ভালোভাবেই। বর্তমানে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বলতে গেলে বিশ্ব বিনোদনের বড় বাজারটি আপনার হাতের মুঠোকেই বোঝায়, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের বিভিন্ন ঘরানার সিনেমা বা যে কোনো ধরণের বিনোদন উপভোগ করতে পারছেন নির্দিষ্ট পরিমাণ সাবস্ক্রিপশন ফি এর বিনিময়ে। এতে দৃশ্যমান দুটি লাভ হচ্ছে।

প্রথমত আপনি আমি চাইলেই আজ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের যে কোনো বিনোদন উপভোগ করতে পারছি, দ্বিতীয়ত বাজার বড় হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারী বাজেট বাড়িয়ে মানসম্পন্ন কন্টেন্ট আমাদের সামনে নিয়ে আসতে পারছেন। সময়ের বিবর্তনে মানুষের রুচি পাল্টেছে, সেই সাথে পাল্টেছে বিনোদনের ধরন ও প্রকৃতি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো যেহেতু সম্পূর্ণই দর্শকের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে তাদের অনুষ্ঠান বানায় তাই আপনি আমি এখানে নিশ্চিত থাকতে পারছি কন্টেন্টের গুণ ও মান নিয়ে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা দেশ ও ভাষার গণ্ডী পেরিয়ে অন্যান্য দেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানতে পারছি।

ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আরেকটি দিক হচ্ছে এখানে যেহেতু বড় বড় ইনভেস্ট এর বিষয়টি এখানে জড়িত তাই শতভাগ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মাধ্যম হওয়াতে এগ্রেসিভ মার্কেটিং এর গুণে কন্টেন্টটি আমার আপনার কাছে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে ওটিটি দুনিয়ার সবথেকে জনপ্রিয় ও দর্শকপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম “নেটফ্লিক্স”। নেটফ্লিক্সের এতো জনপ্রিয়তার পেছনে অনেকগুলো কারনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে এর সম্প্রসারিত রুপ।

এখানে আপনি চাইলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪০০০ টি সিনেমা, বিভিন্ন দেশে প্রায় ২০০০ টি টিভি শো এর ৪৭ হাজারের বেশি পর্ব এবং তাদের নিজস্ব অরিজিনাল সিরিজ দেখতে পারবেন। যেখানে নেটফ্লিক্স এর নিজস্ব অরিজিনাল সিরিজগুলোও বিভিন্ন দেশে তাদের স্থানীয় অভিনয় শিল্পী দ্বারাই নির্মিত। বর্তমানে শুধুমাত্র ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যাই ১৮৩ মিলিয়নের বেশি। বর্তমানে ১৩০ টির অধিক দেশে নেটফ্লিক্স ওটিটি সেবার মাধ্যমে বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে। বড় আকারের দর্শক থাকায় দর্শক এবং নেটফ্লিক্স উভয় পক্ষই লাভবান হচ্ছে। এমনকি বাংলাদশি কয়েকটি মানসম্পন্ন কন্টেন্ট এখন দেখা যায় নেটফ্লিক্সে।

আমাদের দেশেও ওটিটি মাধ্যম বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হটস্টার, হৈচৈ, জি ফাইভ, বঙ্গবিডি, সিনেস্পট, আইফ্লিক্স, বাংলা ফ্লিক্স, বায়োস্কোপ, বিঞ্জি সহ আরো বেশ কিছু ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমাদের দেশের দর্শকের কাছে বিশ্ব বিনোদনের নানান রকম কন্টেন্ট পৌঁছে যাচ্ছে। দিন দিন প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে এসব ওটিটি মাধ্যমগুলোর মধ্যে। যার ফলে একদিকে যেমন বৈশ্বিক বিনোদনের স্বাদ নিতে পারছে দর্শক অন্যদিকে বাড়ছে দেশীয় কন্টেন্ট এ বৈশ্বিক মান বজায় রাখার চাপ।

(চলবে)……



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭