ইনসাইড আর্টিকেল

তের টাকায় কবিয়াল রমেশ চন্দ্র শীল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 21/09/2020


Thumbnail

 

আমরা যে বয়সের বা ধর্মের হইনা কেন, একটি কথা মোটামুটি সবাই কম বেশি শুনে থাকবো। সেটা হল ‘মানুষ মনের গভীর থেকে যদি কিছু চাইতে পারে, তাহলে সৃষ্টিকর্তাও কাউকে নিরাশ করেননা’। অর্থাৎ আমাদের মানুষদের ‘চাইতে’ জানতে হবে। এ চাওয়া মানে ঘরে বসে চাওয়া নয়, ‘চেষ্টা’। তারমানে আপনি যখনি গভীর মনে, একাগ্রতার সাথে কোন কিছু ‘চেষ্টা’ করবেন, সফলতা আপনার অনিবার্য। এ রকম অনেক ব্যক্তি আমাদের পৃথিবীতে ছিলেন এবং আছেন, যারা রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে গিয়েছেন সমগ্র পৃথিবির। আবার কেউ এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে গিয়েছেন সমগ্র রাষ্ট্র বা জাতির। আজ তেমনি একজন গণ্ডি ভেঙ্গে জাতির সম্পদ হওয়া মানুষের গল্প বলব, যার নাম কবিয়াল রমেশ চন্দ্র শীল। যিনি তের টাকা  পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন কবিয়াল হওয়ার।

কবিয়াল রমেশ চন্দ্র শীলের নিজের লেখনিতে পাওয়া যায়, ১৮৭৭ সালে (২৬শে বৈশাখ, ১২৮৪) বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের বোয়ালখালি থানার অন্তর্গত গোমদন্ডী গ্রামের চন্ডীচরণ শীলের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। চন্ডীচরণ শীল পেশাতে ছিলেন নাপিত ও কবিরাজ। স্কুল জীবনে ৪র্থ শ্রেণীতে অধ্যায়নকালে পিতার মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় তার বিদ্যাপাঠ। কাঁধে এসে চাপে সমস্ত সংসার ভার।

“আমিই বালক, চালক,পালক, আমার আর কেহ নাই, মায়ের অলংকার সম্বল আমারা বিক্রি করে খাই”

অবশেষে নিজ পৈতৃক পেশায় ফিরে যান তিনি। একসময় ভাগ্যান্বেষণে পৈতৃক পেশা ছেড়ে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রেঙ্গুন শহরে গমন করেন রমেশ চন্দ্র শীল। সেখানে একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে একটি দোকানেরও মালিক হন। কিন্তু স্বদেশের টানে পাঁচ বছরের মধ্যেই নিজের গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। গ্রামে এসে তিনি পূর্বের নরসুন্দর কাজের পাশাপাশি কবিরাজ (গ্রাম্য চিকিৎসক) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই কবিরাজি করতে করতেই কবিগানের প্রতি ভীষণ ভাবে অনুরাগী হয়ে উঠেন তিনি।

কবিয়াল রমেশ চন্দ্র শীল। ১৮৯৭ সালে প্রথম মঞ্চে কবিগান পরিবেশন করেন কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই। শুরুটা এখান থেকেই,পরবর্তীতে নিজ চেষ্টা আর একাগ্রতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন, বাংলা লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য কবি গানের খাতায়, এবং পরিনত হয়েছেন বাংলা কবি গানের অন্যতম রূপকার হিসাবে। মুলত  তিনি ছিলেন মাইজ ভান্ডারী গানের কিংবদন্তি সাধক। ১৮৯৭ সালে প্রথম মঞ্চে কবিগান পরিবেশনার পরে ১৮৯৮ সালে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে মাঝিরঘাটে দুর্গাপূজা উপলক্ষে কবিগানের আসরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শকের সামনে, মাত্র একুশ বছর বয়সের রমেশ শীলকে প্রতিপক্ষের কবিয়াল মোহনবাঁশি অবজ্ঞা করে বলেছিলেন- এই পুঁচকের সাথে কি পালা করা যায়? ঐ আসরে তিনি দর্শকদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন-

মা আমার রাজকুমারী চন্ডীচরণ বাপ, আমি হয়রে মানুষের বাচ্চা করবো না রে মাফ। জীবনের প্রথম আসরে টানা আট ঘণ্টা গেয়েছিলেন কবিগান। ঐ আসরে কেও কাউকে হারাতে পারেনি। ১৮৯৯ সালে কবিগান পরিবেশনায় প্রতিদ্বন্দী তিনজন কবিয়ালকে পরাজিত করলে উদ্যোক্তা ও শ্রোতাকূলের কাছ থেকে মোট তের টাকা সন্মানী লাভ করেন রমেশ চন্দ্র শীল, যা পেশা হিসাবে পরবর্তীতে কবিগানকে বেছে নিতে রমেশ শীলকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

সাহিত্য জীবনের প্রথম দিকে প্রথাগত কবিয়ালদের মত রমেশ শীল পুরাণ ও কিংবদন্তি নির্ভর গান বাঁধতেন। তখন তার গানের বিষয় ছিল নারী-পুরুষ, সত্য-মিথ্যা, গুরু-শিষ্য, সাধু-গেরস্থ ইত্যাদি কেন্দ্রিক। পরবর্তি কালে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি প্রবলভাবে সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেন। কবিগানের বিষয়বস্তুতে আসে আমুল পরিবর্তন। যুদ্ধ-শান্তি, চাষী-মযুদদার, মহাজন-খাতক, স্বৈরতন্ত্র-গনতন্ত্র, এসব হয়ে যায় কবিগানের উপজীব্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৮ সালে বাংলা কবিগানের ইতিহাসে প্রথম সমিতি গঠিত হয় রমেশ শীলের উদ্যোগে যার নাম ‘রমেশ উদ্বোধন কবি সংঘ’। ১৯৪৮ সালে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কবিকে সম্বর্ধিত ও ‘বঙ্গের শ্রেষ্ঠতম কবিয়াল’ উপাধিতে ভুষিত করা হয়।

এছাড়াও  কবিয়াল রমেশ চন্দ্র শীলের রয়েছে বর্ণাঢ্য সংগ্রামি জীবন। ১৯৪৪ সালে কবি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত কবিয়াল রমেশ শীল সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। তার গণসঙ্গীত দেশের মানুষদের এই সব সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়েছিলেন। যে কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার পরে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সাথে রমেশ শীলকেও গ্রেফতার করা হয়। তার ‘ভোট রহস্য’ পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার। কবি দীর্ঘ্যদিন কারাভোগ করেন এসময়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক সাসনের বিরধিতা করায় রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেষ জীবনে কবি নিদারুণ অর্থ কষ্টের সম্মুখিন হন। কবির প্রথম স্ত্রী ছিলেন অপূর্ববালা, এবং দ্বিতীয় স্ত্রী অবলাবালা। এ ঘরে কবির চার পুত্র ও এক কন্যা জন্মলাভ করে।

পারিবারিক সামাজিক বা অর্থনৈতিক সংকট কখনই একজন মানুষের প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাড়াতে পারেনা যদি তার আন্তরিক চেষ্টা থাকে স্বপ্ন পুরনের লক্ষে। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিজ্ঞানী এ পি জে আবুল কালাম-এর ( যিনি একসময় সাইকেল চালিয়ে বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলিয়ে নিজের লেখাপড়া ও জীবিকা নির্বাহ করতেন ) একটি উক্তি এখানে না বললেই নয়-

 

           “তুমি যে স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখ, সেটা স্বপ্ন নয়; স্বপ্ন সেটা, যা তোমাকে ঘুমাতে দেয়না।”



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭